জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে নিরক্ষর কৃষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে ৫ মাস যাবত ঘরছাড়া তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে বৃদ্ধ কৃষক আবু জামানকে কাবু করতে নারী নির্যাতন, আগুন লাগানো, চুরি এমনকি ডাকাতিসহ পাঁচটি মামলার আসামি করা হয়েছিল।
দখল করে নেয়া হয়েছিল তার বসতভিটার জমিও। স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সামাজিক সালিশি দরবারে শেষপর্যন্ত বসতভিটার জমি ফিরেও পেয়েছেন তিনি।
কিন্তু ধনাঢ্য প্রভাবশালী প্রতিবেশীর রোষানল থেকে মুক্তি পাননি তিনি। ওই প্রতিবেশী মিজানুর রহমান শিকদার অবশেষে অন্যের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে পুঁজি করে নিরক্ষর এবং ফেসবুক বিষয়ে অজ্ঞ আবু জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
এমনকি রুজুকৃত ওই মামলায় ওই ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যক্তির সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা কথিত অপরাধের কোনো দায়দায়িত্ব না থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি স্পর্শকাতর মামলার আসামি হিসেবে গত চার মাস ধরে পুলিশি গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গজারিয়া গ্রামের নিরীহ কৃষক আবু জামান।
গত ২০ অক্টোবর মামলাটি দায়ের করেন গজারিয়া গ্রামের গিয়াসউদ্দিন শিকদারের ছেলে বর্তমানে কটিয়াদী উপজেলা সদরে বসবাসকারী মিজানুর রহমান শিকদার। দীর্ঘ চার মাস ২৩ দিন অতিক্রান্ত হলেও পুলিশ এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি। থেমে আছে তদন্ত কাজও। শুধু থেমে নেই নিরক্ষর কৃষক আবু জামানের পালিয়ে বেড়ানোর কাহিনী।
পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কৃষক আবু জামান।
শনিবার বিকালে নিজ বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক গহীন কলাবাগান এলাকায় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এ কাহিনী শুনিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আশু প্রতিকার ও বিচার চাইলেন ষাটোর্ধ কৃষক আবু জামান।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কটিয়াদি মডেল থানায় গত বছরের ১৯ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বর্তমানে কটিয়াদী পশ্চিমপাড়ায় বসবাসকারী মিজানুর রহমান শিকদার বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করেন।
এ মামলার আসামিরা হচ্ছেন বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় গজারিয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে মো. আল আমিন (২৫) ও এবং গজারিয়া গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে আবু জামান।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, বাদীর পিতা বিলপাড় গজারিয়ার শিকদার মডেল একাডেমির অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন ওরফে গেনু শিকদারের বিরুদ্ধে ১ নম্বর আসামি আল আমিন তার ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দিয়ে বাদীর পরিবারের সামাজিক মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন। মামলার ২ নম্বর আসামি কৃষক আবু জামানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, আসামিরা এলাকায় বাদীর পিতার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলে মানহানি করছেন।
আর এমন এক মামলার আসামি হয়ে গত পাঁচ মাস পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আবু জামান। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান আসামি আল আমিনের সঙ্গে কৃষক আবু জামানের কোনো সম্পর্ক এমনকি যোগাযোগও নেই।
কৃষক আবু জামানের বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী রেহানা খাতুন বলেন, দীর্ঘ পাঁচ মাসের মতো সময় ধরে আমার স্বামী এ মিথ্যা মামলায় পুলিশের ভয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমার স্বামী লেখাপড়া জানেন না, তার ফেসবুকও নাই, তিনি ফেসবুক-টেসবুক কিছুই চিনেন না। শুধুমাত্র আমার স্বামীকে শায়েস্তা করতেই অন্য অচেনা এক ব্যক্তির ফেসবুকে কী লিখেছে- তা দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় ফেলে হয়রানি করা হচ্ছে। এর আগেও পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়ে তারা আমাদের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এবারও বাড়ির জায়গা-জমি ও সীমানা নিয়ে কয়েক দশকের পুরনো বিরোধের জেরে ডিজিটাল মামলায় ‘সাজানো’ আসামি করা হয়েছে আমার স্বামী আবু জামানকে।
আবু জামানের স্ত্রী রেহেনা আক্তারের দাবি, এ মিথ্যা মামলায় তদন্তের নামে সময় নষ্ট করছে পুলিশ। অথচ পুলিশ সুষ্ঠু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসতো আমার নিরক্ষর স্বামী জমিজমা বিরোধের কী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের শিকার।
শনিবার সন্ধ্যায় কটিয়াদী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পুরনো জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষক আবু জামানকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। এছাড়া এখনো অভিযুক্ত ১ নম্বর আসামি আল আমিনের মোবাইল ফোনসেটটি জব্দ করা যায়নি। ফলে সিআইডির কাছে পরীক্ষার জন্য কিছু পাঠানো সম্ভব হয়নি।
এ সময় তিনি বলেন, তদন্তে কৃষক আবু জামান নিরপরাধী প্রমাণ হলে তাকে অবশ্যই অভিযোগপত্র দেয়ার সময় এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।
অপরদিকে এ মামলার বাদী মো. মিজানুর রহমান শিকদার বলেন, মামলার এক নম্বর আসামি আল আমিন কৃষক আবু জামানের কোনো আত্মীয় নন, তবে আবু জামানের কথাতেই ফেসবুকে এ স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে দাবি তার।
এ সময় কৃষক আবু জামানের সঙ্গে জমিসংক্রান্ত বিরোধ এবং এর আগে বাজিতপুর থানায় তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রুজুর কথাও স্বীকার করেন মিজানুর রহমান শিকদার।