খরিয়া নদীকে স্থানীয়রা কুরিয়া নদী নামেও চেনেন। প্রবহমান এ নদীটি ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র থেকে উৎপত্তি হয়ে ফুলপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে হালুয়াঘাটের কংস নদীতে মিশেছে। ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির যৌবনে ভাটা পড়েছে। নদীর মাঝখান দিয়ে সরকারি প্রকল্প দিয়ে করা হয়েছে রাস্তা। শুধু রাস্তা করেই প্রতিবন্ধকতা নয়, নদীর জমি ব্যক্তির নামেও বন্দোবস্ত দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কেবল খরিয়া নদী নয়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে ময়মনসিংহের অন্য নদীগুলোও।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ের কর্মসৃজন প্রকল্প থেকে খরিয়া নদীতে রাস্তা হয়েছে। কাগজপত্রে যদিও প্রকল্পটি নদীতে দেখানো হয়নি। খরিয়া নদীর পাড় থেকে এক ব্যক্তির বাড়ি পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ফুলপুর পৌরসভা ও ফুলপুর ইউনিয়নকে পৃথক করা নদীটি রাস্তা করে সংযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফতেপুর এলাকায় করা রাস্তাটি কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিক দিয়ে মাটির কাজ করানোর কথা থাকলেও স্থানীয়রা বলছেন শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু দিয়ে করা হয় রাস্তাটি। নদীর গতিপথ বন্ধ করে রাস্তা করায় স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। নদীর মাঝে শুধু রাস্তা নয়, ফুলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে নদী শ্রেণির জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে একজন চৌকিদারের নামে। চৌকিদার আবদুল কদ্দুস ও তার স্ত্রীর নামে ২০১৪ সালের দিকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। সেই জমি দখল নিতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। নদী শ্রেণির জমি বন্দোবস্ত দেওয়ায় একটি পক্ষ আদালতে যায়। গত ৮ মার্চ উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায়ও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠে।
এ তো শুধু খরিয়া নদীর চিত্র। নাজুক অবস্থা জেলার ত্রিশাল, ভালুকা ও গফরগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খিরু নদীরও। কয়েক বছর ধরে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর মাছ মরে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। নদীতে নেই আগের মতো প্রবাহও। নদীর মধ্য দিয়ে সরু ড্রেনের মতো করে দেওয়া হয়েছে, যে স্থান দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য যায়। ময়মনসিংহ সদরের সুতিয়া নদী, ঈশ্বরগঞ্জের কাঁচামাটিয়া নদী, নান্দাইলের নরসুন্দা কিংবা তারাকান্দার রাংসা নদী সবই এখন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে পরিণত। ধোবাউড়ার নেতাই নদীটিতেও বইছে দুর্যোগ। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে- ময়মনসিংহ জেলায় নদী ছিল মোট ৪২টি। সেগুলো হচ্ছে- পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, কাঁচামাটিয়া, মঘা, সোয়াইন, বানার, বাইলান, দইনা, পাগারিয়া, সুতিয়া, কাওরাইদ, সুরিয়া, মগড়া, বাথাইল, নরসুন্দা, নেতাই, কংস, খরিয়া, দেয়ার, ভোগাই, বান্দসা, মালিঝি, ধলাই, কাকুড়িয়া, দেওর, বাজান, নাগেশ্বরী, আখিলা, মিয়াবুয়া, কাতামদারী, সিরখালি, খিরু, বাজুয়া, লালতি, চোরখাই, বাড়েরা, হিংরাজানি, আয়মন, দেওরা, থাডোকুড়া, মেদুয়ারি, জলগভা ও মাহারী নদী।
২০১৯ সালের আগস্টে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় নদীর তথ্য সংগ্রহ করেন একজন সহকারী কমিশনার। জাতীয় তথ্য বাতায়নে সেই তালিকা রয়েছে। তালিকায় বলা হয়, ময়মনসিংহে বর্তমানে নদী রয়েছে মাত্র ২৪টি। কালের আবর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খরস্রোতা সব নদী। যে ২৪টি নদীর তথ্য জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়নে রয়েছে সে নদীগুলোর অবস্থাও নাজুক। দখল, দূষণ আর প্রবাহ না থাকায় এখন নদীর পাশ দিয়ে গেলে বোঝার উপায় নেই নিকট অতীতেও নদীতে পানির ঢেউ খেলত। এখন নদীতে চাষ হয় ধানের কিংবা নানা ফসলের। বর্ষায় কিছুদিন পানি থাকলেও বাকি সময় নদীর চিহ্নও বোঝা যায় না। কিছু কিছু নদীতে অল্প পানি থাকলেও আবর্জনা আর বর্জ্যে তা মানুষের ব্যবহার করার জো নেই।
ফুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘খরিয়া নদীতে আমরা বাঁধ দিই নাই। আমাদের যে পর্যন্ত পাওয়ার আছে ওই পর্যন্তই মাটি কেটেছি। পূর্বে স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার মানুষ চলাচলের সুবিধার জন্য নদীতে হাল্ক্কা করে মাটি দিয়ে রাস্তা করেছিল। এবার প্রকল্পের কাজের সময় সুবিধাভোগীরা হয়তো সেখানে মাটি ফেলেছে। সে সময় তিনি সেখানে ছিলেন না।’ পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘নদীর তো একটি নির্দিষ্ট এরিয়া রয়েছে। আমার মনে হয়, ওই পর্যন্ত নদী নয়।’ তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা জাকারিয়া আলম বলেন, প্রকল্পটি চেয়ারম্যানের করা। কাজের সময় এলাকার লোকজন সেখানে নদী ছিল কিনা, সে বিষয়ে কিছু জানায়নি।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে নেওয়া প্রকল্পটি নদীর মাঝখান দিয়ে দেখানো হয়নি। প্রকল্পটি ঠিক থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে প্রকল্পের বাইরে বেশ কিছু মাটি সেখানে পড়ে গেছে। ওই অবস্থায় বলা হয়েছে- নদীর প্রবাহ বন্ধ করা যাবে না। চেয়ারম্যানকে মাটি সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নদী শ্রেণির জমি কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। বিষয়টি জানাতে এসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জেলা পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, ক্রমশ নদীর সংখ্যা কমে আসছে। এমনটি চলতে দেওয়া যায় না। নদীর সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি। নদীর জমি বরাদ্দ দেওয়া কিংবা নদীতে সরকারি প্রকল্প দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
‘জনউদ্যোগ’ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, দেশের নামই নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদী যদি না থাকে তবে দেশের নামকরণই অর্থহীন হয়ে পড়বে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশাসন তথা বাংলাদেশ নদী কমিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে কোনোভাবেই নষ্ট করতে দেওয়া চলবে না। নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হবে।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, নদীগুলো নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হবে। দখলমুক্ত করে পর্যায়ক্রমে নদীগুলোকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে।