নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরীর বালু এলাকাবাসীর অভিশাপ হয়ে উঠেছে। বালু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া ভাবে বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। পৌর শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীটি এক সময় ছিল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য লীলাভূমি। ওই নদীর চরে থাকা বালু সরকারি ইজারায় বিক্রি করা হলেও কোন প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইজারাদারগণ বাংলা ড্রেজারের মাধ্যমে ড্রেজিং করে অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীটি বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
জেলার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী থেকে গত কয়েক বছর ধরে বালু উত্তোলনের নামে চলছে বালুদস্যুতা। ভেজা বালু পরিবহনের কারনে পরিপাটি পৌরশহর সবসময়ই কাঁদা পানিতে ভরে থাকে। নদীর পানি সড়কের ওপর পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অসাধু বালু ব্যবসায়ীরা সোমেশ্বরী নদীকে করছে ক্ষতবিক্ষত। এতে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও নদীর তীরবর্তী সাধারণ মানুষ। সরকার পাচ্ছে নামে মাত্র রাজস্ব।
ভেজা বালু পরিবহনে রাস্তা ভাঙ্গণের কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় ৩ শ ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুর্গাপুর-শ্যামগঞ্জ মহাসড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙ্গে যাচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। কেবলমাত্র প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের অসাধুতা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে পৌরবাসীর জনজীবন। মুনাফালোভী এই সম্প্রদায়ের দৌরাত্মের কারণে লড়ি-ট্রাকগুলোতে অতিরিক্ত বালু বোঝাই থেকে শুরু করে সড়কে চলে অদক্ষ চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
পৌর শহরের ভিতর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বালুবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে দুর্গাপুরের প্রতিটি সড়কে বেহালদশা বিরাজ করছে। প্রতিনিয়ত সড়কে ঝড়ছে প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনা এখানে নিত্যদিনের সঙ্গী। বালুবাহী ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে ২০২০ সালে ঝড়ে গেছে শিক্ষার্থীসহ ৮২জনের প্রাণ। আহত হয়েছেন প্রায় ২শ জনের মতো। এর আগেও আরও ৪ শিশু মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দুর্গাপুরের বিভিন্ন স্থানে লড়ি ও ট্রাকের চাপায় মারা যায়। সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু এ ধরনের অপমৃত্যু মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন।
নিরাপত্তার দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী সম্প্রতি লাগাতার আন্দোলন করলেও টনক নড়েনি স্থানীয় প্রশাসন ও বালু ব্যবসায়ীদের। স্থানীয় প্রশাসনকে কব্জায় রেখে বালু ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মকান্ড চালাচ্ছে বীরদর্পে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক নদীর চরের বালু ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করে নেয়ার কথা থাকলেও দিনের পর দিন বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে উত্তোলন করছে বালু ও পাথর। এ যেন জনগনের সাথে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। জেনেও না জানার ভাব করছে স্থানীয় প্রশাসন।
দুর্গাপুরকে স্থানীয়রা একসময় শান্তির জনপথ বলে গর্ববোধ করতো। সেই জনপদে এখন ভয়ের রাজত্ব চলছে। ঘর থেকে বের হলে বালুবাহী ট্রাক-লড়ির চাপায় পিষ্ট হওয়ার ভয়, আবার ঘাতকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হুমকি- ধামকি, অত্যাচার, নির্যাতন, লাঞ্চিতের শিকার হওয়ার ভয়, দোকান-পাট বন্ধ করে দেয়ার ভয়। গত কয়েকদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে প্রকাশ্যে হামলা করে ৭ শিক্ষার্থীকে মারাত্মকভাবে আহত করে কতিপয় সন্ত্রাসী। এসবের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ালেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।
এ সময়ে পর্যটকদের ভিড়ে পৌরশহরের দোকান গুলোতে আদিবাসী পোষাক কেনার ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু বর্তমানে রাস্তায় কাঁদা থাকার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। শহরের দোকান গুলোয় ক্রেতাশূন্য অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। এ নিয়ে গত ২৪ জানুয়ারী শহরের সকল ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে বাইপাস সড়ক নির্মাণের দাবীতে ধর্মঘট শুরু করেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ বাইপাস সড়ক দিয়ে বালু পরিবহন করার আশ্বাস প্রদান করলে বন্ধ হয় ধর্মঘট। মাত্র কয়েকদিন যেতে না যেতেই ফের শুরু হয় ভেজা বালু পরিবহন।
সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষা দুর্গাপুর ও সোমেশ্বরী নদী দেশের জাতীয় সম্পদ। পর্যটনশিল্পে অপার সম্ভাবনাময় এমন সম্পদ ইচ্ছেমত সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। দুর্গাপুরের সাধারণ মানুষ ও সোমেশ্বরী নদীর দুর্দশা নিরসনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী।