ফসল ও ফল চাষে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত বা ক্ষতিকারক পদার্থের বিষয়টি মাথায় এলেই যেন গা শিউরে উঠে। কেননা অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে কেবল মানুষই অসুস্থ হচ্ছে না, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। অনেকেই ফল খাওয়া বন্ধ করে দিলেও উপায়হীন হয়ে সবজি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারছেন না। সব ধরনের শঙ্কা দুর করে কৃষিবিদদের নিরলস শ্রম ও প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিবেশ বান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের “জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই দমন ব্যবস্থাপনা প্রদর্শনীর আওতায় ময়মনসিংহের ত্রিশালে ১’শ একর জমিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন ৫’শ কৃষক।
অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। পরিবেশ ভারসাম্য হারানোর ফলে জীববৈচিত্রও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকর পোকার সাথে উপকারী পোকাগুলোও মারা যাচ্ছে। কৃষক ও পরিবেশকে রক্ষা করতে এই প্রথম ময়মনসিংহ বিভাগের শুধুমাত্র ত্রিশালের রামপুর ইউনিয়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইপিএম প্রকল্পের আওতায় মডেল প্রকল্প হিসেবে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষ শুরু হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে পরিবেশ বান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের “জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই দমন ব্যবস্থাপনা প্রদর্শনী”র আওতায় আইপিএম এর ওই মডেল ইউনিয়নে ১’শ একর জমিতে বাস্তবায়িত হয়েছে । ২০টি গ্রুপে ২৫ জন করে মোট ৫০০ জন কৃষক/কৃষাণীর সমন্বয়ে জৈব কৃষি ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে রবি মৌসুমের টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শসা, শীত লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও মরিচসহ অন্যান্য সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। নির্বাচিত এক’শ একরের সবজিক্ষেতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ইস্পাহানি এগ্রো লিমিটেডের পরিবেশ বান্ধব ভার্মিকম্পোস্ট এবং ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, আঠালো ফাঁদ, নেট হাউজ, জৈব বালাইনাশক ইকোমেকস ও বায়োট্রিনসহ ইত্যাদি প্রযুক্তি। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রত্যেক কৃষককে প্রকল্পের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে সবজির চারা উৎপাদনের বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এসব ফাঁদ ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের পদ্ধতির ওপর দুই ধাপে কৃষক/কৃষাণীদের দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ। শেখানো হয়েছে ফাঁদ স্থাপনের নিয়ম কানুন। সবজির ভাইরাস বাহক পোকা দমনের জন্য রামপুর ইউনিয়নে নির্মাণ করা হয়েছে ৮টি নেট হাউজ।
সরেজমিনে সবজির গ্রাম নামে পরিচিত রামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকার পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে সবজি ক্ষেতে পাতা হয়েছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, আঁঠালো ফাঁদ। আর ফাঁদে আটকে মারা যাচ্ছে ক্ষতিকর পোকা। প্রদর্শনী সবজি ক্ষেতে লাগানো সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ রঙের আঁঠালো ফাঁদ গুলোও অপূর্ব এক সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। গাছে দুলছে লাউ ও টমেটো। ক্ষেতে শোভা ছড়াচ্ছে সবুজ সতেজ পাতার সারি সারি ফুলকপি ও বাঁধাকপি। পুরো ক্ষেত জুড়ে যেন বিশাল এক সবুজের সমারোহ।
কৃষক আলিউল, সুরুজ আলী, নজরুল, মহরচান, মুঞ্জুরুল, কৃষানী পারুল বেগম, রিনা খাতুন, শাহনাজ বেগম ও মুর্শিদা খাতুনসহ অনেক কৃষক জানান রাসায়নিক সার না ব্যবহার করেও ফলন খুব ভালো হয়েছে। অনেক সচেতন ভোক্তারা এখন সবজি কিনতে ক্ষেতেই চলে আসেন। এতে আমাদের আশপাশের অন্য কৃষকরাও বিষমুক্ত সবজি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
ইস্পাহানী এগ্রো লিমিটেডের ময়মনসিংহ অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষিবিদ মারুফ গনি বলেন, রাসায়নিক কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ভয়াবহতা ও ভবিষ্যত পরিণতির কথা চিন্তা করে ইস্পাহানি এগ্রো লিমিটেড ২০০৯ সাল থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জৈব বালাইনাশক সার উৎপাদন শুরু করে। জৈব বালাইনাশক বর্তমানে কৃষকের কাছে এক পরিচিত নাম। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে।
বিশেষ দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. এনামুল হক জানান, প্রদর্শনী দেখে আইপিএম পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছেন অনেক কৃষকরাও।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদ জানান, “কীটনাশকের পরিবর্তে বালাইনাশক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে প্রত্যেক কৃষককে বিনামূল্যে চারার বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। দুই ধাপে কৃষক/কৃষাণীদের দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ।