নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্যাংক, বীমা, আর্থিক খাতের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের কোম্পানির শেয়ার কিনে লোকসান গুনছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এমনকি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেও লোকসানের মধ্যে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একের পর এক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে যেখানে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়েছে, সেখানেই ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ) ‘আলাদিনের চেরাগ’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই ডিবিএইচ’র ওপর ভর করেই সার্বিক শেয়ার ব্যবসায় মুনাফায় রয়েছে ডেল্টা লাইফ। অথচ ডিবিএইচ’র হিসাব বাদ দিলে সার্বিক শেয়ার ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান করেছে এই জীবন বীমা কোম্পানি।
কোম্পানিটির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডেল্টা লাইফ ব্যাংকখাতের ১৬টি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ১৫টিতেই লোকসান হয়েছে। ব্যাংকখাতে বিনিয়োগ করে একমাত্র পূবালী ব্যাংকের শেয়ারে মুনাফার দেখা পেয়েছে কোম্পানিটি। ১১০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনা পূবালী ব্যাংকের শেয়ারের বাজার দর দাঁড়িয়েছে ১২৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ পূবালী ব্যাংকের শেয়ারে মুনাফা হয়েছে ১৮ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
এরপরও ব্যাংকখাতের শেয়ার কিনে কোম্পানিটি ১৯ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা লোকসান করেছে। আর পূবালী ব্যাংকের মুনাফা বাদ দিলে ব্যাংক খাতে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ৩৮ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের শেয়ারে দুই কোটি ৭২ লাখ ৬৮ হাজার, সিটি ব্যাংকের শেয়ারে ১৭ কোটি ২৬ হাজার, ব্র্যাংক ব্যাংকের শেয়ারে এক কোটি ৫৩ লাখ ৬৭ হাজার এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের শেয়ারে তিন কোটি ২২ লাখ ৯২ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
এছাড়া ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ১৩ লাখ ৮০ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ২৬ লাখ ২৯ হাজার, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে এক কোটি আট লাখ ৪৮ হাজার, আইএফআইসি ব্যাংকে এক কোটি ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার, ইসলামী ব্যাংকে এক কোটি সাত লাখ ২২ হাজার, ওয়ান ব্যাংকে এক কোটি ৮০ লাখ ৯৫ হাজার, প্রাইম ব্যাংকে তিন কোটি ২৩ লাখ ৬৯ হাজার, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ২৪ লাখ এক হাজার, সাউথ ইস্ট ব্যাংকে ৫১ লাখ ২৮ হাজার, ইউসিবিতে তিন কোটি ৫২ লাখ এবং উত্তরা ব্যাংকে ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা লোকসান করেছে ডেল্টা লাইফ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকৌশলখাতের আটটি কোম্পানির শেয়ার কিনে সবক’টিতেই লোকসান করেছে ডেল্টা লাইফ। আর্থিকখাতের সাতটি কোম্পানির শেয়ার কিনে ছয়টিতেই লোকসান হয়েছে। জ্বালানিখাতের তিনটিতে লোকসানের বিপরীতে দুটিতে মুনাফা হয়েছে। বীমা, সিরামিক, করপোরেট বন্ডখাতে একটি করে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রতিটিতেই লোকসান হয়েছে।
এছাড়া আইটির দু’টির দুটিতেই, বিবিধের পাঁচটির চারটিতে, ওষুধের পাঁচটির তিনটিতে লোকসান করেছে ডেল্টা লাইফ। এমনকি ১৫টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে প্রতিটিতেই লোকসান করেছে এই জীবন বীমা কোম্পানি।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এভাবে লোকসান করলেও আর্থিকখাতের প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের শেয়ারে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে। কোম্পানিটির শেয়ারে মাত্র সাত কোটি ২৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ডিবিএইচ মুনাফা করেছে ২৭০ কোটি ৬৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
এই অস্বাভাবিক মুনাফার বিষয়ে ডেল্টা লাইফের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মিল্টন ব্যাপারী বলেন, ‘ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার রয়েছে। আমাদের দু’জন পরিচালক ওখানে আছেন। আমরা ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের শেয়ার নতুন করে কিনিনি এবং বিক্রিও করিনি। তবে বিভিন্ন সময়ে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার পেয়েছি, এতে শেয়ার সংখ্যা বেড়েছে। যে কারণে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের প্রতিটি শেয়ারের গড় ক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ৩৯ পয়সা। এ কারণেই এই কোম্পানি থেকে আমরা বড় মুনাফা করেছি।’
এদিকে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করে ডেল্টা লাইফ লোকসান করায় একাধিক বীমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, জীবন বীমা কোম্পানির টাকা মূলত পলিসি গ্রহকদের। একটি জীবন বীমা কোম্পানি কোথায় বিনিয়োগ করতে পারবে, তার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। এমনকি কোন ধরনের কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে তাও আইন দিয়ে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং ডেল্টা লাইফ শেয়ারে বিনিয়োগ করে যে ধরনের লোকসান করেছে তা ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, কোনো বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে কি-না তাও ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে লোকসান করার বিষয়ে সিএফও মিল্টন ব্যাপারীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সবাই মুনাফার আশায় বিনিয়োগ করে। আমরাও মুনাফার আশায় শেয়ারে বিনিয়োগ করেছি। তবে দাম কমে যাওয়ার সময় ধারণা করেছিলাম দাম বাড়বে। কিন্তু পরবর্তীতে আরও দাম কমেছে। এ কারণেই লোকসান হয়েছে। আইন মেনেই শেয়ারের এই বিনিয়োগ করা হয়েছে। শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আইন লঙ্ঘন করা হয়নি।’