চলচ্চিত্র ও নাটকের প্রবীণ অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, যাকের ভাই গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ক্যানসারে আক্রান্ত এই অভিনেতা করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সপ্তাহ দুই আগে।
রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত রোববার বাসায়ও ফিরে গিয়েছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুক্রবার ভোরে সেখানেই মারা যান তিনি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, শেষ দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল আলী যাকেরের। সে কারণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার জন্য শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন রাখা হয়নি।
১৯৪৪ সালের ৬ই নভেম্বর জন্ম আলী যাকেরের। ১৯৭২ সালে তিনি আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ওই দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে ।
১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। আলী যাকের ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাভিশনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান ভালোবাসার বাংলাদেশ উপস্থাপনা করেন।
নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিশ্বখ্যাত বিদেশি নাটকের বাংলা রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনা নিয়ে আলী যাকের ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ওই দলে যোগ দেন সারা যাকের যাকে শুরুতে চোখেই পড়েনি আলী যাকেরের। একটি নাটকের প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারা যাকেরকে দেওয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে চরিত্রটার জন্য তাকে তৈরি করার এবং খুব দ্রুত চরিত্রটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন সারা যাকের। এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান আলী যাকের। ১৯৭৭ সালের এই ঘটনার রেশ ধরেই আলী যাকের আর সারা যাকেরের বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুই সন্তান, পুত্র অভিনেতা ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া।
নব্বই দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাড়া জাগানো জনপ্রিয় নাটক ‘আজ রবিবার’। আজ রবিবার’ নাটকের দর্শকদের অতি পরিচিত চরিত্র বড় চাচা। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকের অন্যতম চরিত্র বড় চাচা আসগর। ‘নাটকে বড় চাচা মানে ডা. এস আসগর পিএইচডি প্রাপ্ত একজন বিখ্যাত মানসিক রোগের চিকিৎসক। তিনি নিজেকে ছাড়া বাড়ির সবাইকেই মানসিক রোগী মনে করেন। ঘরের দরজায় তিনি একটি ফুটো করে রেখেছেন বটে কিন্তু তার ভেতর দিয়ে যে তাকায় তাকেই পড়তে হয় বিপদে। এ চরিত্রে অদ্ভুত সুন্দর চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনেতা আলী।
টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চেও অভিনয় করেন আলী যাকের। অভিনয়খ্যাতির পাশাপাশি কলামিস্ট হিসেবেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছ, ১৯৮৬ সালের ‘আগামী ‘ ১৯৯৬ সালের নদীর নাম মধুমতী’, ২০০১ সালের ‘লালসালু’, ,২০০৮ সালের ‘রাবেয়া’। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে আছ,‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘একদিন হঠাৎ’ ও ‘পাথর সময়’। আর উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নাটকের তালিকায় আছে, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’,’গ্যালিলিও’ ও ‘কবর’।
আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকেরও মঞ্চ আর টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ইরেশ যাকের ও শ্রেয়া সর্বজয়া তাদের দুই ছেলে-মেয়ে।