লাল-নীল-হলুদ বাতি জ্বালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলছে লাল রঙের গাড়ি। আমরা সবাই বুঝে গিয়েছি কোথাও আগুন লেগেছে। মূলত আমরা গাড়ির লাল রঙ দেখেই চিনে ফেলেছি এটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি মানেই লাল রঙ হবে।
তবে কখনও কি প্রশ্ন জেগেছে, কেন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল? হয়তো প্রশ্ন জেগেছে কিন্তু জানা হয়ে উঠেনি।
বর্তমান বিশ্বে লাল রঙের গাড়ি জরুরি ব্যবস্থার গাড়ির প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই রঙ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক কারণ থাকলেও ঐতিহ্য বেশি ভূমিকা রেখেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ কবে থেকে লাল হলো বা কেন লাল রঙ ব্যবহার করা হয় এর নিশ্চিত কোনও ডকুমেন্টস নাই। মূলত এ বিষয় অনেকগুলো তত্ত্ব রয়েছে।
তবে সত্যি কথা হলো বিশ্বের সব দেশের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল নয়। বিভিন্ন দেশে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ বিভিন্ন রঙের রয়েছে। কোথাও হলুদ, কোথাও সবুজ, কোথাও সাদা এমনকি কালো রঙেরও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রয়েছে। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল। মূলত ঐতিহাসিক কারণেই এই রঙ পছন্দ করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল কেন এ নিয়ে জনপ্রিয় তত্ত্বের একটি হলো— বিশ্বে ১৮ শতকে ফায়ার সার্ভিস প্রাতিষ্ঠানিক আকারে গঠিত হওয়া শুরু করে। এ সময় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ফায়ার সার্ভিসকে আলাদাভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জরুরি কাজে যাওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে। তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য লাল রঙ ব্যবহার করা হয়। কেননা ১৮ শতকে লাল রঙের দাম ছিল খুবই বেশি। যা ফায়ার সার্ভিসকে একধরনের উচ্চস্তরে পৌঁছে দেয়।
আরেকটি তত্ত্বটি হলো, ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসের প্রথম দিকে যখন অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত গাড়ি ছিল না, তখন আগুন নির্বাপণ করার জন্য কৃষকের কাছ থেকে কৃষকের গাড়ি নিতো। আর সে সময় কৃষকের গাড়ি রঙ ছিল লাল। এই ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল হয়ে উঠে।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল কেন এ নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব— ১৯২০ সালের দিকে ফোর্ড কোম্পানি তাদের বিখ্যাত ‘টি’ মডেলের গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। এ সময় কালো রঙের দাম কম থাকায় ফোর্ড কোম্পানি তাদের গাড়ির রঙ কালো করে। বাজারে এই গাড়ি এত বেশি পরিমাণে ছিল যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হয়। তখন থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল করা হয়। এভাবে বিগত ১০০ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল হয়ে আসছে।
তবে বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল থেকে ভিন্ন রঙে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল হবার পরও শুধু চোখে না পড়ার কারণে অন্যান্য গাড়ির সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের লাল রঙের গাড়ি থেকে অন্যান্য রঙের গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনায় কম পতিত হয়েছে। যেমন ২০১৮ সালে আমেরিকাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অন্যান্য গাড়ির সাথে ১৪ হাজার ৫০০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য আমেরিকান ফায়ার সার্ভিস অ্যাডমিনেস্টেশন গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতিফলনশীল হলুদ-সবুজ এবং কমলা রঙের গাড়ি দিনের আলোতে ভালো দেখা যায়। রাতে লাইম গ্রিন রঙ ভালো দেখা যায়। অবশ্য ৯০ দশকের পর থেকে আমেরিকান ফায়ার সার্ভিস গাড়ির রঙ লালের বদলে লাইম গ্রিন রঙ করা হচ্ছে।
এছাড়া জরুরি বিষয়ক গাড়ির ওপর মানুষের মনস্তাত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, লাল ও লাইম গ্রিন রঙের মধ্যে কম আলোতে লাইম গ্রিন রঙের গাড়ি দ্রুত মানুষের চোখে পরে। এমনকি ২০০৯ সালে করা আমেরিকার ফেডারেল ইমার্জেন্স ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকাতে ফায়ার কর্মী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধানতম কারণ হলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া।
এদিকে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের ৪৭ জন ফায়ারফাইটার অপারেশনাল কাজ করার সময় মারা যান। এর মধ্যে ১৮ জনই মারা গিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এসবের কারণে বিশ্বের অনেক দেশই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল থেকে লাইম গ্রিন বা হলুদ রঙ করছে। ১৯৭৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া সকল জরুরি বিভাগের গাড়ির রঙ হলুদ ব্যবহার করে আসছে।
যাইহোক, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া বা মানুষের চোখে দৃশ্যমান বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা লাল রঙের বিপক্ষে গেলেও বিশ্বে এখনও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির লাল রঙ বেশ জনপ্রিয়। একশত বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এই লাল রঙ করার ঐতিহ্য বহণ করে আসছে। মূলত ঐতিহ্যের কারণেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রঙ লাল করা হয়।
লেখক: তালহা বিন জসিম,
স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স