রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হবে। এত দিন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বা এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ জন্য মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীসহ মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ–২০২৫–এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে গতকাল বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ–সংক্রান্ত সংশোধিত খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের বিষয়টি বৈঠক শেষে জানানো হলেও ভ্যাটের বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা
এনবিআর–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাটের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটি হলে পোশাক কেনার খরচও বাড়বে মানুষের। এ ছাড়া মিষ্টি কিনতে গেলেও খরচ বাড়তে পারে ভোক্তার। কারণ, মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া ভ্রমণের ক্ষেত্রে নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট হারও বাড়তে পারে। বর্তমানে নন–এসি হোটেল সেবার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে হঠাৎই ভ্যাট, সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন ধরনের কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর সূত্রে কিছু পরিবর্তনের বিষয়ে জানা গেছে।
এ–সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদনও দিয়েছে। শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সাপেক্ষে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ থেকে ভ্যাট বাড়ানোর আদেশ জারি করা হবে বলে সূত্রটি জানায়।
রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অব্যাহতির সংস্কৃতি পরিহার করে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি; হ্রাসকৃত হার ক্রমান্বয়ে সংকোচন করে আদর্শ হারে উন্নীত করা এবং কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্যে ভ্যাটের হার যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের একটি মিশন। চলমান এই ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয়েছে আইএমএফ। তবে এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। মূলত আইএমএফের শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতির সামগ্রিক বাস্তবতায় সরকারের ওপর দায়দেনার চাপ বাড়ছে। সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য–সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে, এটা সত্য। আবার আমাদের রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত খুবই কম। সেটি বাড়ানোও দরকার। এ জন্য প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষ যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকেও নজর দিতে হবে।’
ছোটরাও আসতে পারে টার্নওভার করে
৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে।
এ ছাড়া মদের বিলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মদের পাশাপাশি আমদানি, উৎপাদন ও সেবা পর্যায়ে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। যেমন আমদানি পর্যায়ে ফলের রসে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ; তামাকে ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ; সুপারিতে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কথা বলায় (টকটাইম) সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে বলেও এনবিআর সূত্র জানায়।
ভ্রমণে আবগারি শুল্ক বাড়তে পারে
আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বেড়ে যেতে পারে। কারণ, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হতে পারে। আর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হতে পারে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বিমানের টিকিট কাটার সময় বাড়তি এই শুল্ক আদায় করা হবে।
এনবিআরের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় সংসদ ছাড়া কর বাড়ানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই রাষ্ট্রপতির আদেশে অধ্যাদেশ দিয়ে কর বাড়াতে হয়। নতুন ভ্যাট হার কার্যকরে তাই রাষ্ট্রপতির জারি করা অধ্যাদেশের মাধ্যমেই সেটি করা হতে পারে। আগামী সপ্তাহে এই অধ্যাদেশ জারি হতে পারে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।