আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মারণাস্ত্র নিষিদ্ধ চান জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। একই সঙ্গে জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ছররা গুলির ব্যবহারও চান না তারা। আগামী ডিসি সম্মেলনে এ প্রস্তাব উঠতে যাচ্ছে। সম্মেলনকে সামনে রেখে ডিসিদের দেওয়া এসব প্রস্তাব এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রস্তাবের পক্ষে মতামত দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, আগামী মাসের প্রথমার্ধেই ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই হতে যাচ্ছে প্রথম ডিসি সম্মেলন। মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় এবং সরকারের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সাধারণত প্রতি বছর এ সম্মেলন হয়ে থাকে। বছরের মাঝামাঝি জুন-জুলাইয়ে আয়োজন করা হলেও করোনা মহামারির কারণে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। করোনার কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২২ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি এ সম্মেলন হয়। গত বছর ২০২৩ সালে ডিসি সম্মেলন হয় ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি। সর্বশেষ সম্মেলন এ বছর ৩ থেকে ৬ মার্চে হয়।
সম্মেলনের কার্য-অধিবেশনগুলোতে সাধারণত মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকেন। সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা লিখিতভাবে মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রস্তাব দেন। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসিরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাবও তুলে ধরেন। কার্য অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তবে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এবারের সম্মেলনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের পরিবর্তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকবেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনাসহ তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন ডিসিরা। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এবারের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টা সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। তার সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন ডিসিরা। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত এবং স্পিকার না থাকায় এ সেশনটি এবার থাকছে না।
সূত্র জানায়, এবারের ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে কার্যপত্র তৈরি করতে যথারীতি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সে অনুযায়ী নিজ বিভাগ ও দপ্তর সম্পর্কিত নানা ধরনের প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিরা। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, এসব প্রস্তাব স্বল্প মেয়াদে (এক বছর), মধ্য মেয়াদে (তিন বছর) ও দীর্ঘ মেয়াদে (পাঁচ বছর) বাস্তবায়নযোগ্য কি না, সে ব্যাপারে মতামত চেয়ে গত ২৫ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখায় পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় এ চিঠিতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জেলার ডিসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারণাস্ত্র ও ছররা গুলি ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাব পাঠান। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মারণাস্ত্র ও ছররা গুলির ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ছররা গুলি মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া গুলিতে প্রাণহানির কথাও উল্লেখ করেন তাদের কেউ কেউ। ডিসিদের করা এমন প্রস্তাবে সায় দিয়ে মতামত তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
সূত্র আরও জানায়, কয়েকজন ডিসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যরত অবস্থায় বাধ্যতামূলক বডি ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিতকরণের প্রস্তাব দেন। কয়েকজন ডিসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে (সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের বাসভবন) কেপিআই নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব দেন। এসব প্রস্তাবের পক্ষে মতামত দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।