চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে একমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন হিসেবে টানা ১০ বছর চলেছে ‘বিজয় এক্সপ্রেস’। গত বছর এই ট্রেনের রুট জামালপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে, রুটের দৈর্ঘ্য বাড়লেও কমেছে যাত্রী। তাই বিকল্প ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে।
২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর চালু হয় বিজয় এক্সপ্রেস। জামালপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ট্রেনটির স্টার্টিং পয়েন্ট পরিবর্তন করে জামালপুর স্টেশন থেকে চালানো হয়। রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে চলাকালে ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসে আয় হয় চার কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ সময়ে আসনের বিপরীতে ৭৮ শতাংশ যাত্রী পাওয়া যেত। চট্টগ্রাম-জামালপুর-চট্টগ্রাম রুটে চলাকালীন চলতি বছরের এপ্রিল-জুন মাসে আয় হয় চার কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। আসনের বিপরীতে গড়ে ৬৭ শতাংশ যাত্রী মেলছে এখন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুট বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে একই সময়ে ট্রেনটি ৬৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা বেশি আয় করেছে। কিন্তু গড়ে যাত্রীর সংখ্যা কমেছে ১১ শতাংশ। গত ৫ নভেম্বর রেল ভবনে অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ‘রুট রেশনালাইজেশন’ সভা থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।
রুট বাড়লেও যাত্রী বাড়েনি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজয় এক্সপ্রেস যখন ময়মনসিংহ থেকে ছাড়ত, তখন ট্রেনটি সময়সূচি মেনে চলত। কিন্তু জামালপুরে আসার পর তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে ট্রেনের যাত্রীরা চট্টগ্রাম যাচ্ছেন বিকল্প পথে। এ ছাড়া মাঝপথে ওয়াটারিং, ইঞ্জিন বিকল ও ক্রসিংয়ের কারণে শিডিউল মেনে চলতে পারছে না ট্রেনটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুট বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে একই সময়ে ট্রেনটি ৬৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা বেশি আয় করেছে। কিন্তু গড়ে যাত্রীর সংখ্যা কমেছে ১১ শতাংশ। গত ৫ নভেম্বর রেল ভবনে অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ‘রুট রেশনালাইজেশন’ সভা থেকে এমন তথ্য জানা গেছে
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াসিফ রাশেদ ময়মনসিংহের বাসিন্দা। তিনি বিজয় এক্সপ্রেসের নিয়মিত যাত্রী। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম আসতে ট্রেনটির সময় নির্ধারণ করা আছে আট ঘণ্টা ৫০ মিনিট। এখন সময় লাগছে ১১ থেকে সাড়ে ১১ ঘণ্টা। ট্রেনটি যখন ময়মনসিংহ পর্যন্ত ছিল তখন এই অসুবিধা হয়নি। ইঞ্জিন দুর্বল, প্রায়ই পথে বিকল হয়। কোনো কারণে দেরি হলে চট্টগ্রাম থেকেও ছাড়তে দেরি করে। জামালপুর পর্যন্ত ট্রেনটি নেওয়ার পর এখন আর ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের টিকিট পাওয়া যায় না। ফলে ময়মনসিংহ থেকে উঠলেও বেশিরভাগ সময় জামালপুর স্টেশন থেকে টিকিট বুকিং করতে হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রেলফ্যান গ্রুপগুলো থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ২৪ মে জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে বিজয় এক্সপ্রেস (৭৮৬) ট্রেনটিতে চারটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল। ওইদিন জামালপুর থেকে ট্রেনটিকে টেনে আনছিল রেলওয়ের ২৯১৯ নম্বর ইঞ্জিন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর স্টেশন এলাকার কাছে ইঞ্জিনটি ফেইল করে। পরে ময়মনসিংহ থেকে ২৬১৪ নম্বর ইঞ্জিন এনে রওনা করে ট্রেনটি। ওই ইঞ্জিন বিজয় এক্সপ্রেসকে নিয়ে ভৈরব সেতুতে উঠতে না পারায় আখাউড়া থেকে ২৯২৩ নম্বর ইঞ্জিন এনে ট্রেনটিকে টেনে নেওয়া হয়। পরে এই ইঞ্জিনও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বারৈয়ারঢালা এলাকায় ফেইল করে। পরে চট্টগ্রাম থেকে ২৯৩৭ নম্বর ইঞ্জিন এনে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেওয়া হয় বিজয় এক্সপ্রেস।
বিজয় এক্সপ্রেস বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ট্রেন। যাত্রী কেন কম— এমন প্রশ্নের জবাবে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনের রুট যত দীর্ঘ হয়, ঘুরিয়ে আনতে তত বাধা-বিপত্তি। জামালপুরে নেওয়ার পর ওয়াটারিং ও মেইনটেনেন্সে অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, এই সুবিধাগুলো আছে ময়মনসিংহ স্টেশনে। ফলে সময়সূচি রক্ষা করা যাচ্ছে না। বিজয় এক্সপ্রেস একটি মাত্র রেকে চলে। ফলে কোনো একদিন আসতে দেরি করলে পরে তা ঠিক করা যায় না। ট্রেনটি ময়মনসিংহ থেকে চালাতে পারলে সময় বাঁচবে এবং যাত্রীও বাড়বে।
শিডিউল অনুযায়ী বিজয় এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে যাত্রা করে জামালপুর পৌঁছায় সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে। দুই ঘণ্টা বিরতি শেষে রাত ৮টা ১০ মিনিটে আবার চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে।
জামালপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশনের মাষ্টার দেওয়ান হারুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ওয়াটারিং সুবিধা নেই। চট্টগ্রাম থেকে আসার পর ট্রেনে শুধু ঝাড়ু দেওয়া হয়।
যাত্রী কম কেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিকটবর্তী স্টেশন পিয়ারপুর। এর আগে যেসব ট্রেন আছে, সেগুলোতে পিয়ারপুরের যাত্রীরা চলে যান। সন্ধ্যার পরে ময়মনসিংহ যাওয়ার আরও দুটি ট্রেন আছে জামালপুর থেকে। ওই দুটি ট্রেনে ময়মনসিংহের যাত্রীরা আগেই চলে যান। ফলে কাছাকাছি স্টেশনের যাত্রী পায় না ট্রেনটি। কিন্তু জামালপুর থেকে চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ সব টিকিট বিক্রি হয়।
বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের এক লোকোমোটিভ মাস্টার নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনটি ময়মনসিংহ থেকে ভালোই চলত। তখন কোনো ঝামেলা ছাড়া নির্ধারিত সময়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু জামালপুর আসার পর থেকে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা সামনে আসে।
প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রেনটি জামালপুরে নিয়ে আসার পর দুই ঘণ্টা বিরতি থাকে। কিন্তু জামালপুরে ট্রেনটি শুধু পরিষ্কার করা হয়। এরপর ময়মনসিংহ আসার পর ট্রেনে পানি নেওয়া হয়। এটি ২০ মিনিটে করা হয়। মাঝেমধ্যে একটু বেশি সময়ও লাগে। আবার পথে নানা সময় ক্রসিং, ইঞ্জিন জটিলতায় দেরি হয়। বিজয় এক্সপ্রেসে সাধারণত ২৯০০ সিরিজের পুরোনো ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। ট্রেনটি ভোর সাড়ে ৫টায় চট্টগ্রাম পৌঁছায়। সেখানে পাঁচ ঘণ্টার মতো বিরতি পাওয়া যায়। যেহেতু ট্রেনটি নিয়মিত চলে, তাই এখানে পুরো ট্রেনের মেইনটেনেন্স করা হয়। চাইলে আসা মাত্রই ট্রেনটিকে আবার জামালপুরের উদ্দেশে পাঠানো যায় না। ফলে যদি কোনো কারণে একবার দেরি হয়, সেই জের টানতে ট্রেনের পরবর্তী ছুটির দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, ট্রেনের রেক একটাই।
বর্তমানে নির্ধারিত সময়ে ছাড়া যাচ্ছে না বলে পুরো ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা কম— মনে করেন বিজয় এক্সপ্রেসের এই লোকোমাস্টার।
রেলওয়ের রুট রেশনালাইজেশন সভায় বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে, এটি আগের মতো চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে পরিচালনার বিষয়টি পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে, এটি আপাতত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মানুষের দুর্ভোগ হবে, এমন কিছু করা যাবে না।’
জামালপুরেই ওয়াটারিং-মেইনটেনেন্স ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেবা দেওয়ার পর হঠাৎ সেটি সরিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। ইতোমধ্যে জামালপুর থেকে যারা এই ট্রেনের যাত্রী হয়েছেন, তাদের ওপর অন্যায় করা হবে। যাত্রীদের পর্যাপ্ত সেবা না দিয়ে আয় কম হচ্ছে বলে রুট কমিয়ে নেওয়া অনুচিত। রেল হচ্ছে সাবসিডিয়ারি মোড। ভাড়া কম বা বেশির চাইতে যাত্রীসেবা দেওয়াটাই তাদের মূল লক্ষ্য। রুট না কমিয়ে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার প্রতি তাদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।
সেক্ষেত্রে জামালপুরে ওয়াটারিং ও মেইনটেনেন্সের ব্যবস্থা রেখে রেলওয়ের যে দুর্বলতাগুলো আছে, বিশেষ করে জনবল বাড়িয়ে সেবা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তার মতে, ‘সেবা দিতে না পেরে একটি রুটের কিছু স্টেশন কমিয়ে দেব, এটা আমার কাছে মনে হয় ভুল দর্শন। আমাদের খুব বিলাসী প্রকল্পের দরকার নেই। প্রকল্প হতে হবে খুবই সাধারণ এবং স্বল্প ব্যয়ের। যাতে মানুষ উপকৃত হয়। অস্থায়ীভাবে জামালপুর স্টেশনে ওয়াটারিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এজন্য একটি প্রকল্প নিলে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না।’
বিজয় এক্সপ্রেসের যাত্রী বাড়াতে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ হলো, ‘ট্রেনকে অবশ্যই সময়সূচি মেনে চলতে হবে। যাতে যাত্রীদের স্টেশনে বসে সময় নষ্ট করতে না হয়। কারণ, আমাদের স্টেশনগুলো কিন্তু যাত্রীবান্ধব নয়। দীর্ঘসময় সেখানে থাকতে হলে তাকে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। রেলের লোকোমোটিভ ও কোচের যেমন সংকট রয়েছে, একইসঙ্গে তাদের মানেরও সংকট আছে। এসব জায়গায় কাজ করলে আমি মনে করি রেলওয়ে আরও বেশি যাত্রী পাবে। কারণ, রেলের মতো এত নিরাপদ ও সময়োপযোগী বাহন আর অন্য কিছু হতে পারে না।’
প্রসঙ্গত, বিজয় এক্সপ্রেস যাত্রাপথে ১২টি স্টেশনে বিরতি দেয়। মঙ্গলবার বন্ধ থাকে এটি। ৬২১ আসনের ট্রেনটি গত সেপ্টেম্বর মাসে আয় করেছে এক কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
সূত্র ঢাকা পোস্ট