১১ জুন ১৮৮৫, শুভ জন্মদিন উকিল মুন্সি
“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালী বাতাসে-
বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসে রে”।।
নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি, নূরপুর বোয়ালী, গ্রামে ১৮৮৫ সালের ১১ জুন একটি ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে উকিল মুন্সী জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম আব্দুল হক আকন্দ। শৈশবে তিনি ঘেটুগানে যোগ দেন। পরে গজল ও পরিণত বয়স থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাউল সাধনায় লিপ্ত থাকেন। তার গজল গানের সূত্রপাত হয় তরুণ বয়সে। তার চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়ি মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামে বেড়াতে যান। সেখানে ধনু নদী’র পারের এক গ্রামের লবু হোসেনের মেয়ে হামিদা খাতুনের (লাবুশের মা) প্রেমে পড়ে যান তিনি। এই প্রেম নিয়ে তিনি লিখেন “উকিলের মনচোর” নামক একটি গান। তার চাচা এই প্রেমের কথা জানার পর হামিদার বাবা সাধারণ কৃষক হওয়ায় তাকে পরিবার থেকে বিয়েতে বাঁধা দেন। এরপর তিনি বাড়ি ছেড়ে শ্যামপুর, পাগলাজোড়, জৈনপুরে ঘুরে বেড়ান। ১৯১৫ সালে জালালপুর গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের এক মসজিদে ইমামতি ও আরবি পড়ানোর কাজে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ইমামতির পাশাপাশি গজল লিখতেন এবং রাত জেগে তা গাইতেন।
এতে বিরক্ত হয়ে এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে উকিলের নামে নালিশ করেন। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যেতে আসলে উকিল পুলিশ নিয়ে গান শুরু করেন। সে গানে পুলিশ তার নিজের ভিতরে লুকোনো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে তাঁকে আর ধরে নিয়ে যাইনি। পরে কয়েকটি পালাগানের মঞ্চে উকিলের গান শুনে সেই পুলিশ উকিলের মুরিদ হয়ে যান।
তার গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এ ছাড়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল সমান। কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা জানাযার ইমামতির জন্য তাঁকে ডাকতেন। এমনও হয়েছে- গানের আসরে বিরতি দিয়ে জানাযার নামাজে তাঁকে ইমামতি করতে হয়েছে।
উকিল মুন্সী এবং তাঁর পীরকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা প্রচলিত আছে। তিনি আল্লাহওয়ালা মানুষ, নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন, তার সাথে পীরের সম্পর্ক ছিলো অন্য ভক্তদের চেয়ে আলাদা। পীর সাহেব নিজে গান না করলেও গানের কারণে উকিলকে বেশি স্নেহ করতেন। একবার পীরের দরগায় ওরছ ছিলো। শরীর খারাপ থাকায় উকিল যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব বেজায় রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন- উকিল মুন্সী আসলে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবা না, তার জন্য ওরছটাই নষ্ট হলো। কয়েকদিন পর উকিল মুন্সী পীরের সাথে দেখা করতে গেলেন। তিনি পীরের ঘরে ঢোকার আগেই গানে টান দেন- বন্ধু নিঃদুনিয়ার ধনরে…। এই গান শুনে পীর ঘর থেকে বের হয়ে উকিলকে হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল, আমাদের বললেন তারে যেন ঘরে উঠতে না দিই। আর এখন আপনি নিজেই তপস্যা ভেঙ্গে তারে নিয়ে যেতে আসলেন। পীর সাহেব কিছুই বললেন না শুধু চোখের জল ছেড়ে দিলেন। তাঁর লেখা গান জনমানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অতি সমাদৃত। জন্মদিনে লোককবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখা: জাহিদুল কবির, সংগীত বিভাগ, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।