নিজস্ব প্রতিবেদক
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন (রাষ্ট্রীয়) প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রায় ৩৪ হাজার ৬১৫টি অডিট আপত্তি উঠেছে, যাতে জড়িত টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি প্রায়।
এ টাকা দিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে যে ঘাটতি হিসাব করা হয়েছে তার পুরোটাই মেটানো সম্ভব। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপির প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, তারা তাদের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট নিষ্পন্ন করতে ত্রিপক্ষীয় সভাসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এরপরও বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে নতুন নতুন আপত্তি ওঠায় টাকার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে লাখ কোটি অতিক্রম করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেতন, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট নিয়ে অডিট আপত্তি ওঠে। ফলে এতে জড়িত টাকার পরিমাণও কম হয়। তবে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক বেড়ে যায় মূলত নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ প্রদান ও সে ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার কারণে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মগুলো হয় নানা কৌশলে। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর খেলাপি হওয়া, শর্ত ভঙ্গ করে ঋণ গ্রহণ ও জাল অ্যামেন্ডমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে। এ ছাড়া মালামাল ঘাটতি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হওয়ার পরও প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ আদায়ে উদ্যোগী না হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি ঋণের অর্থ আদায়ে তদারকির অভাবে ক্ষতি, লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিস্ট (এলটিআর) মঞ্জুরের পর পাওনা অর্থ আদায় না হওয়া, জামানত ছাড়া এলটিআর ঋণ মঞ্জুরের মতো অনিয়ম, বন্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ে ব্যর্থতা, অনাদায়ী ঋণের ওপর পুনরায় ঋণ ইস্যু, এলসির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ অনাদায়ী অবস্থায় পুনরায় ঋণ ইস্যুর মতো অনিয়মের কারণে শত শত কোটি টাকার অডিট আপত্তি ওঠে।
জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম সম্প্রতি তার বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে যে সমন্বয় সভা করেন, সেখানেও অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পন্নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ওই সভায় উপস্থাপিত তথ্যে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তির কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৭৩২টি সাধারণ আপত্তিতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৭১ হাজার ৯৯৭ কোটি, ১৭ হাজার ৭০২টি আপত্তিতে ৮৬ হাজার ৬৮৮ কোটি, ১৪৬টি খসড়া আপত্তিতে ৩ হাজার ১৫০ কোটি ও সংকলনভুক্ত ১ হাজার ২৮টি অভিযোগের বিপরীতে ২৩ হাজার ১২৭ কোটি। সভার কার্যপত্রে মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে এসব অডিট আপত্তির উল্লেখ থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের অধীন ২৬টি প্রতিষ্ঠানের অডিট আপত্তির হিসাব এ তথ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কার্যপত্রে অডিটের সংখ্যা, ধরন ও টাকার অঙ্ক উল্লেখ থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী পরিমাণ অনিয়মের অভিযোগ তা উল্লেখ ছিল না।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারাও কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বীমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইডরা), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)র মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়াও সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে তারা দ্রুত এসব অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলেও কভিড-১৯-এর কারণে গত মার্চের পর থেকে নিয়মিত এসব সভা করতে পারেননি। সে কারণেই অডিট আপত্তিতে টাকার অঙ্ক বেড়েছে বলেছে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে এবং অফিস-আদালতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে আমরা আবার অডিটগুলো নিষ্পন্নের জন্য ত্রিপক্ষীয় সভার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এরই মধ্যে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ বিষয়ে কম্পোট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল অফিসের ডেপুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মো. মাহবুবুল হক বলেন, পরিচালনা নীতির ক্ষেত্রে সমস্যার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট আপত্তি বাড়ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তারা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে। এ কারণে অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন-ভাতা, বোনাসসহ নানা ইস্যুতে অডিট আপত্তি বাড়ে।
মাহবুবুল হক বলেন, অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তি ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোকে। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের উদ্যোগের পরও নতুন করে আরও বেশি অডিট আপত্তি উঠছে। যত দিন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা নীতির মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর না হবে তত দিন এ ধরনের আপত্তি উঠতেই থাকবে।