নেত্রকোনার হাওরবেষ্টিত একটি উপজেলা খালিয়াজুরী। এ উপজেলায় বছরের আট মাসই পানি থাকে। শুকনো মৌসুমেও প্রবহমান থাকে খরস্রোতা ধনু নদী। এ কারণে কোনো দিনই চার চাকার গাড়ি দেখার সৌভাগ্য হয়নি খালিয়াজুরীবাসীর। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস টিকার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থেকে চার চাকার দুটি গাড়ি আনতে হয়েছে এই উপজেলায়, যা দেখে স্থানীয়রা বর দেখার মতো উৎসুক হয়ে ওঠে। এ ঘটনা গতকাল বুধবার বিকেলের।
গত বছর মাত্র তিনটি অটোরিকশা চলত পুরো উপজেলা শহরে। যদিও সরকার ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে করে দিয়েছে ডুবন্ত সড়ক। কিন্তু একটি মাত্র সেতুর অভাবে এই শহরে চার চাকার গাড়ি দেখেনি কেউ কোনো দিন। স্থানীয়রা বলছেন, ধনু নদীতে একটি সেতু হলে বদলে যেতো পুরো অঞ্চলের চিত্র।
স্থানীয়রা জানান, লাল ও কালো রঙের দুটি চার চাকার গাড়ি চলার দৃশ্য দেখতে রাস্তার দুপাশে ভিড় জমিয়েছিল শত শত মানুষ। গাড়িগুলো প্রত্যন্ত হাওরের পথ ধরে যেতে যেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে হাজির হয়। আর এই স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছে।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম জানান, ফাইজারের টিকা সরবরাহ করতে হয় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রার গাড়িতে করে। কিন্তু রাস্তার অভাবে দুর্গম জনপদ খালিয়াজুরীতে গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়। এমন চিন্তা করে খালিয়াজুরীর টিকা কার্যক্রম পার্শ্ববর্তী মদন উপজেলা সদরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু বাদ সাধে উপজেলার বাসিন্দারা। তারা ৩০ কিলোমিটার দূরে মদনে গিয়ে টিকা গ্রহণে আপত্তি জানান। তারা যেকোনো উপায়ে খালিয়াজুরীতে টিকা পৌঁছানোর অনুরোধ করেন স্থানীয় প্রশাসনকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির পর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষায়িত গাড়ি দিয়েই খালিয়াজুরীতে টিকা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
টিকা নিয়ে যাওয়া গাড়ি দুটির মধ্যে লাল রঙের গাড়িটি খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। আর কালো রঙের গাড়িটি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার। গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও খালিয়াজুরী উপজেলা সদরে এর আগে কোনো দিন তাদের গাড়ি পৌঁছায়নি।
খালিয়াজুরী সদরের পুরানহাটি গ্রামের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘খালিয়াজুরীর যোগাযোগব্যবস্থা অনেক দুর্গম। ২০১৭ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন খালিয়াজুরী উপজেলা সদর সফর করেন, তখন তাঁর গাড়িও আনা সম্ভব হয়নি। তিনি হেলিকপ্টারে এসেছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর একটি সাধারণ রিকশায় চড়েন তিনি। খালিয়াজুরীবাসীর দুঃখ ধনু নদী। ওই নদীতে একটা সেতু খুব জরুরি দরকার।’
খালিয়াজুরী সদরের রঞ্জিত সরকারের স্ত্রী আশা রাণী সরকার (৬৩) বলেন, ‘জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, এত সুন্দর গাড়ি দেখিনি। কেউ অসুখে মারা গেলেও কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। নদীর এপাড়ে ধানের দাম দেড় শ থেকে দুই শ টাকা কমে বিক্রি করতে হয়। এ রকম গাড়ি আসলে আমরা ধানের ঠিক দাম পাইতাম।’
খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সানোয়ারুজ্জামান তালুকদার জোসেপ বলেন, ‘এই প্রথম খালিয়াজুরীতে কোনো চার চাকার গাড়ি এল। আমাদের ধনু নদীতে একটি ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা করা হলে কৃষ্ণপুর, নগর লেইপসিয়া ইউনিয়নে মোটামুটিভাবে গাড়ি চলাচল করতে পারবে, যেটা শুকনো মৌসুমে এখানকার মানুষের জন্য খুবেই উপকারী হবে।’
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘একটি বড় ট্রলারের পাটাতনে কাঠের তক্তা বসিয়ে পার করা হয় গাড়িগুলো। ৩০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে টিকা নিতে অনেকে আপত্তি তোলায় আমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা তাতে সফল হয়েছি। শুধু গাড়ি পৌঁছাইনি, টিকাগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখার জন্য আমরা একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষেরও ব্যবস্থা করেছি।’