১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীদের পরাস্ত করে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলাকে দখল মুক্ত করে। এই নয় মাসে উল্লেখযোগ্য গণহত্যা ও সন্মুখ যুদ্ধ করে নালিতাবাড়ীকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সীমান্ত ঘেঁষা এই অঞ্চলে পাকহানাদাররা সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করেন ঝিনাইগাতীর আহাম্মদ নগরে। এরপর নালিতাবাড়ীর বর্তমান উপজেলা পরিষদ, রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট অফিস, হাতিপাগার বিডিআর ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকেই চলে তাঁদের এই অঞ্চলে নির্যাতন।
১৯৭১ সালের ২৫ মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালায় উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও সীমান্তের এই স্থলবন্দর এলাকায়। পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়েছে সেদিন নিহত হন অসংখ্য বাংলাদেশী ও ভারতীয় নিরীহ মানুষ। এদিন পাক-হায়েনাদের হামলায় নিহত হওয়া ৯ জন বিএসএফ সদস্যের হিসেব জানা গেলেও বাংলাদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায়নি। অনেক লাশ ভোগাইনদীতে ভেসে যায়। আর যাদের লাশ পাওয়া যায় তাঁদেরকে নাকুগাঁও সীমান্ত এলাকার নোমেন্স ল্যান্ড এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। নয়জন বিএসএফ দের স্মরণে ভারতীয় অংশে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে ভারতীয়রা। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও বধ্যভূমিটিকে রক্ষার কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বধ্যভূমিটি পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। এমনকি এখানে সরকারিভাবে দিবসটি পালন করাও হয় না।
৩০ জুন তন্তর গ্রামের সাত জনকে হত্যা করে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। নন্নী বারমারী সড়কে একজন ক্যাপ্টেনসহ ছয়জন সৈন্য জিপ দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনী আতংকিত হয়ে পড়ে। শেষে কৌশল পরিবর্তন করে নালিতাবাড়ী থানা সদরে রাজাকার আল বদরদের সহায়তায় শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে।
২৫ জুলাই উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে ২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। ওইসময় হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ১৪ জন নারী। সেদিন কলাপাতা, ছেড়া শাড়ী আর মশারী দিয়ে কাফন পড়িয়ে ৪/৫ টি করে লাশ এক একটি কবরে দাফন করা হয়েছিল। আবার কোন কোন কবরে ৭/৮টি করে লাশও এক সাথে কবর দেওয়া হয়েছিল। ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জীবন্ত স্বাক্ষী রয়েছেন অনেকেই। সেদিন সোহাগপুর গ্রামের সকল পুরুষ মানুষকে হত্যা করায় পরবর্তীতে ওই গ্রামের নাম হয় ‘বিধবা পল্লী’। এরপর বিধবাদের জীবন চলে খেয়ে না খেয়ে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের জন্য ভাতা ও একটি করে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হয়েছে। এবং একটি স্মৃতি সৌধের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও ১৪ জন নির্যাতনের শিকার নারীকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।