মাত্র দেড় বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মো. রুবেলের মা ও বাবার মৃত্যু হয়। কোনো রকম ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায় সে। মা ও বাবার মৃত্যুর পর তার আশ্রয় হয় বাবার চাচাতো বোনের বাসায়। অভাব ও দারিদ্র্যতার মধ্যেও ফুফুর আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকেন তিনি।
স্থানীয় শিক্ষালয় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করার পর তিনি ভর্তি হয় গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে। হঠাৎ ফুফুর মৃত্যুতে তার স্বপ্ন পূরণের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি ড্রাইভিং শিখে চালকের চাকরি নেন।
তিনি ২০১৯ সালে আঁখি আক্তার নামের একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তাদের ঘর আলো করে জন্ম হয় রুবাইয়ার। মেয়ে জন্মের ৩ দিন পরই আঁখি আক্তারের মৃত্যু হয়। এবার একমাত্র মেয়েকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রুবেল। মায়ের শূন্যতায় গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মেয়েকে বড় করতে থাকেন, মাসিক বেতনে রাখেন একজন গৃহপরিচারিকাকে। সংসার যেন ছিল বাবা ও মেয়ের। তাদের খুনসুটিতে যেন দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল।
বাবার হাতে গোসল, বাবার হাতে খাওয়া, বাবার কোলে ঘুম শিশুটির সবই ছিল বাবাকে ঘিরেই। মায়ের শূন্যতাও যেন বাবাই ভুলিয়ে দিয়েছিল। সে সুখও সইলো না রুবেলের কপালে।
গত ৩০ নভেম্বর দুপুরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন রুবেল। আর শিশুটি খেলছিল ঘরের ভেতর। হঠাৎ করেই বাবার চোখের আড়াল হয়ে যায় সে। একটি জামা হাতে ঢুকে পড়ে গোসলখানায়। সেখানে জামাটি ভিজাতে গিয়ে উল্টে গামলার পানিতে করুণ মৃত্যু হয় রুবাইয়ার। বাবা রুবেল মিয়াও হারান তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে। এখন কি নিয়ে বাঁচবেন রুবেল মিয়া! ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের নানান প্রশ্নে প্রতিমূহূর্ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে এখন তাকে।
রুবেল মিয়া ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ গ্রামের আব্দুল হেকিম ও হালিমা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান। বর্তমানে থাকেন গাজীপুরে শ্রীপুরের মুলাইদ গ্রামে। বয়স ৩০ এর কোটা অতিক্রম করা যুবক রুবেল একের পর এক স্বজন হারিয়ে এখন বুকে পাথর চাপা পড়েছে। নিজের মনের অব্যক্ত কথাগুলোও যেন প্রকাশ করতে কষ্ট হয়।
রুবেল মিয়া বলেন, ছোটকালে বাবা ও মায়ের ভালোবাসা কি রকম তার টের পাইনি। যখন বড় হলাম তখন তখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল, নিজে লেখাপড়া করে ভালো কোনো চাকরি করবো। অভাব ঘুঁচিয়ে সংসার পাতবো। অভাবের কারণে স্নাতক আর শেষ করে উঠতে পারেননি তিনি। পরে একটি সময় এসে সংসার করে সুখের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটাও মেলাতে পারেননি নিজের ভাগ্যের সঙ্গে। দুনিয়াতে আসার শুরুতে মা ও বাবা, পরে স্ত্রী, সর্বশেষ সন্তান চলে যাওয়ায় এখন যেন হৃদয় শূন্য হয়ে গেছে তার। বারবার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে কষ্টের ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো। এখন যে তার আর কোনো কাছের স্বজন বলতে আর কেউ নেই। কাকে নিয়ে বাঁচবেন তিনি? এমন প্রশ্ন ছিল তার।
তিনি বলেন, স্ত্রী চলে যাওয়ার পর তিনি যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, হৃদয়ের বাধন আলগা হয়ে পড়ায় তার সমস্ত অস্তিত্বই যেন ইতি টানছে। গত ২৩ মাস ধরে মা হারা মেয়েকে বড় করতে তার কত রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তার শত কষ্ট মিলিয়ে যেত মেয়ের একটু হাসিতেই। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেকেই তাকে বিয়ের পরামর্শ দিয়েছিল। তবে সৎ মা কিভাবে নেবে এটা ভেবেই তিনি বিয়ে করেননি। তিনি তার মেয়ের বাবা ও মা একাই হতে চেয়েছিলেন।
শ্রীপুরের মাওনা গ্রামের মো. নাইম মিয়া বলেন, রুবেল দীর্ঘদিন ধরেই তার গাড়ি চালান। সে খুবই বিনয়ী ও ভদ্র। একজন সন্তানের জন্য বাবার কি পরিমাণ ভালোবাসা থাকে তা প্রায় দুই বছর সময় ধরে দেখেছি। মেয়েটিকে হারিয়ে সে এখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।