মালিকের অটোরিকশা চালাতে গিয়ে দিনমজুরের ছেলে চালককে অচেতন করে অটো নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। অসুস্থ চালককে উদ্ধারের পর চোর সন্দেহে রাতভর আটকে রাখা হয় মালিকের বাড়িতে। সকালে সালিসকারীদের সামনে হাজির করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরদিন বিকেলে জিডিতেই ঘটনাটি ফয়সালা হয়। এ অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ থেকেই ওই দিন গভীর রাতে মারা যায় চালক। এ ঘটনায় অটোর প্রভাবশালী মালিকের ভয়ে কোনো রকম বিচার ছাড়াই তড়িঘড়ি নিহতের লাশ দাফন করে ফেলে। ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার পাশপাশি নিহতের মা মিনা আক্তার বুকফাটা কান্না করে ছেলে হত্যার বিচার দাবি করছেন। এ ধরনের ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের উত্তর পালাহার গ্রামে।
খবর পেয়ে আজ সোমবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ আগে শেষ হওয়া জানাজার পর নিহতের লাশ দাফনের কাজে ব্যস্ত পরিবারের লোকজন। আর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মা,অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী ও বোনের আহাজারিতে কাঁদছে আগত লোকজন। খবর পেয়ে স্ত্রী কবিতা আক্তার এসেছেন ভৈরব থেকে। তাকে জানানো হয় জ্বরে মারা গেছে তার স্বামী। পরে জানা যায় নিহত শামীম মিয়া হচ্ছেন ওই গ্রামের দিনমজুর আব্দুল হাইয়ের ছেলে।
নিহত শামিমের মা মিনা আক্তার জানান, শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে শামীম কয়েকজন যাত্রী নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের দিকে গিয়েছিলেন। পরে তাকে আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজের পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এলাকার লোকজন। খবর পেয়ে ইজিবাইকের মালিক নাসির ও তার লোকজন শামিমকে উদ্ধার করে তার (নাসির) বাড়িতে নিয়ে যায়। নাসিরের বাড়ি হচ্ছে শামীমের বাড়ির পাশেই। এ সময় ছেলেকে ফিরে পেতে অনেক আকুতি-মিনতি করেও ফেরত পাননি। রাতে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে নাসিরের বাড়িতে গিয়ে আনতে গেলে অটো রিকশার দেড় লাখ টাকা দাবি করে নাসিরের পরিবার। টাকা দিলেই বাড়ি যেতে পারবে শামীম। এ অবস্থায় সকালে বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে বসে সালিস। সেই সালিসে অটোর মালিক নাসির তার বাড়ি থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শামীমকে কয়েকজনে ধরে হাজির করে। পরে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য্য করে ছেলেকে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেন।
মিনা আক্তার আরো জানান, এর মধ্যে সালিশের অপর সিদ্ধান্তে তাকে নাসির থানায় নিয়ে যায় জিডি করাতে। ওই সময় কর্তব্যরত কর্মকর্তা জিডিতে শামীমকে চোর হিসেবে দোষি সাব্যস্ত করলে জিডির লেখা পরিবর্তন করে আনতে বলেন। পরে গতকাল রবিবার বিকেলে থানায় অন্য প্রকারের জিডি করেন। এদিকে গুরুতর অসুস্থ শামীম রবিবার রাত ১২টার দিকে মারা যায়। খবর পেয়ে নাসিরের লোকজন সহানুভূতি জানাতে বাড়িতে এসে দ্রুত লাশ দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। তাদের কথায় লাশ দাফন করা হয়।
নিহতের বোন জানান, সালিসে ধার্যকৃত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে নাসিরের লোকজন বাড়িতে এসে তার মাকে কুড়াল ও বাঁশ দিয়ে মারতে উদ্যত হন। এক পর্যায়ে গোয়াল ঘরে থাকা গরু নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দেয়। এ সব ঘটনার সকল কিছুই গুরুতর অসুস্থ ভাই শুনতে পেরে আরো অসুস্থ হয়ে যায়। তিনি ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য নাসিরকেই দায়ী করেন।
সালিশকারী আবুল কাশেম বলেন, মো. নজরুল ইসলাম জানান, ইজিবাইক খোঁয়া যাওয়া নিয়ে গ্রামে একটি সালিস বসানো হয়েছিল। ওই সালিসে অটো খোয়া যাওয়ায় মোট টাকাকে তিনভাগ করে শামীমকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়। কিন্তু মালিক পক্ষ না মানায় কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ করা হয়।
সালিসে উপস্থিত আরেক বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, সালিসে শামীমকে জরিমানা ধরার প্রস্তাব উঠলেও তার আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
অভিযুক্ত নাসির এক রাত শামীমকে তার ঘরে রাখার কথা স্বীকার করে বলেন, যদি সে পালায় এই জন্যই আমার হেফাজতে রাখা হয়েছিল। তবে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। অসুস্থ হয়েই মারা গেছে।
নান্দাইল থানার ওসি মিজাননুর রহমান বলেন, বিষয়টি জেনে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।