জামালপুরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ২৪ ঘন্টায় একদিনে ৮৩টি নমুনা পরীক্ষায় করোনার রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৫ জন। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় দৈনিক শনাক্তের হার উঠেছে ১৮ দশমিক শূন্য ৭ ভাগে। চলতি বছরের গত দুই মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যুসহ জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ৩৫ জন। করোনার সংক্রমণরোধে চলমান সরকারি বিধি-নিষেধ জেলার কোথাও মানা হচ্ছে না। ফলে সারা জেলায় ফের করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, জামালপুর জেলায় করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় দৈনিক শনাক্তের হার সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক শূন্য ৭ ভাগে দাঁড়ায়। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুর সদর উপজেলাসহ জেলার সাতটি উপজেলা থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করেছে ৮৩টি। এতে করোনা পজিটিভ হয়েছে ১৫ জনের। এর মধ্যে জামালপুর সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি নয়জন করোনার রোগী শনাক্ত হয়েছে।
গত ১ জুন থেকে আজ ৯ জুন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ৯ দিনে সারা জেলায় ৫৭০ জনের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ হয়েছেন ৮৭ জন। এই ৮৭ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭০ জন শনাক্ত হয়েছেন জামালপুর সদর উপজেলায়। সদর উপজেলায় শনাক্ত হওয়া এই ৭০ জনের মধ্যে জামালপুর পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে শনাক্ত হয়েছে ৪৯ জন।
জেলায় করোনার সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখীর পাশাপাশি করোনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৫ জন। তাদের মধ্যে গত এপ্রিল মাসে আটজন, মে মাসে দু’জন এবং সর্বশেষ ৫ জুন একজনসহ চলতি বছর করোনায় মারা গেছেন ১১ জন। এর আগে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জেলায় করোনায় মারা গেছেন ২৪ জন। জামালপুর জেলায় কোনো ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিদ্যমান রয়েছে, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের নমুনার জিনোম সিকুয়েন্সির মাধ্যমে জেলা স্বাস্থ্যবিভাগ সেই তথ্যও নিশ্চিত হতে পারেনি।
এদিকে জামালপুর জেলা ভারত সীমান্তবর্তী একটি জেলা। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের সীমান্তঘেষা জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা সীমানা। এ দুটি উপজেলায় সড়ক পথে ভ্রমণের জন্য ভারত-বাংলাদেশের কোন ইমিগ্রেশন কেন্দ্র নেই। বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর সীমান্তে একটি ল্যান্ড কাস্টমস বা স্থলবন্দর রয়েছে। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে কারফিউসহ কঠোর লকডাউনের কারণে গত ৫ মে থেকে কামালপুর স্থলবন্দর দিয়ে দুই দেশের পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। ফলে পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে আসছে না বলে সেখানকার আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে জামালপুর জেলা-ভারত সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান বন্ধে সীমান্তরক্ষী বিজিবি কর্তৃপক্ষ তাদের নজরদারি আরো বাড়িয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
জামালপুর সদর উপজেলার মধ্যে জামালপুর পৌরসভা এলাকা একদিকে ঘনবসতিপূর্ণ, অন্যদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা জজ আদালত, ২৫০ শয্যার জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল, ইউএনও কার্যালয়, জামালপুর পৌরসভা কার্যালয়, জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়, ব্যাংক-বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি সকল দপ্তরের প্রধান কার্যালয়, অভিযাত মার্কেট, বিপনিবিতান, হোটেল রেস্তরাঁ থেকে শুরু করে সবকিছুই জামালপুর পৌরসভা এলাকার মধ্যেই পড়েছে। ফলে জেলার বাকি ছয়টি উপজেলা মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশিগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলা থেকে এবং সারাদেশ থেকে প্রতিদিন নানা কাজে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এই জামালপুর পৌরসভা এলাকায়।
কিন্তু এই পৌরসভা এলাকাসহ সারা জেলার কোথাও করোনার সংক্রমণ রোধে জারি থাকা সরকারি কঠোর বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। একেবারেই শিথিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ রোধে জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের কার্যকর কোন উদ্যোগ না থাকায় ক্রমেই এই জেলায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী গতিকে ঠেকাতে না পারলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই জেলায় করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে জনমনে শঙ্কা দেখা বাড়াচ্ছে।
এদিকে জামালপুর সদর উপজেলাসহ সারা জেলায় করোনার সংক্রমণের মাত্রা উর্ধ্বমুখী বিরাজ থাকায় জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. প্রণয় কান্তি দাস বলেন, করোনার রোগী দ্রুত বেড়ে গেলে হাসপাতাল আইসোলেশন ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে নতুন করে ফের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জামালপুর সদর হাসপাতালের চারতলায় নিউ কেবিন ওয়ার্ডে ছয়টি কেবিন ও পুরুষ অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের ১২টি বিছানা কিছুদিন আগে চালু করা হয়েছে। একই সাথে চারতলায় ডায়রিয়া ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ড ঘোষণা করে সবকিছু ঠিকঠাক করা হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছর শহরের মনিরাজপুরে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে চালু করা ১০০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালটিও প্রস্তুত রাখার কাজ চলছে।
তিনি আরো জানান, জামালপুর সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মজুদ আছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন আগে থেকেই চালু আছে। বর্তমানে অক্সিজেন প্লান্ট থেকেই হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে সরাসরি রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার থেকেও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা সদরের বাইরে বাকি ছয়টি উপজেলা হাসপাতালেও সিলিন্ডার অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি করোনার রোগীর সংখ্যানুপাতে হাইপো নেজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র যে কয়টা আছে তাতে চলবে। তবে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে তখন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
করোনা সংক্রমণরোধে বিধি-নিষেধের শিথিলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে গঠিত জেলা কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মুর্শেদা জামান ও অন্যান্য সদস্যরা সবাই করোনা সংক্রমণরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।