১৯৬৭ সালের জুনের ৫ তারিখ। ছয় দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেদিন। সময় তখন বেলা ১২টা বেজে ৪৮ মিনিট। চারটি ইসরাইলি জঙ্গী বিমান ধেয়ে আসছে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে গোটা মিশরীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এবার জর্ডানের ছোট্ট বিমান বাহিনীর উপর আক্রমণ শাণাচ্ছে ইসরাইলি বিমানগুলো।
ঠিক ঐ মুহূর্তে ইসরাইলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গী বিমানগুলো আরবীয় আকাশে ভয়ঙ্করতম আতঙ্কের নাম। প্রচণ্ড গতি আর বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে সেগুলো ছারখার করে দিতে পারে আকাশপথের যে কোনো বাধা কিংবা ভূমিতে অবস্থানকারী যে কোনো টার্গেটকে। তবু তাদের পথ রোধ করতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে বুক চিতিয়ে উড়াল দিল চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমান। শক্তির দিক থেকে ইসরাইলি বিমানের কাছে সেগুলো কিছুই নয়। মুহূর্তেই উড়ে যেতে পারে এক আঘাতে, তাতেই গুঁড়িয়ে যাবে তাদের প্রতিরোধের স্বপ্ন।
কিন্তু ইতিহাস দুঃসাহসের পূজারী। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল মাফরাকের যোদ্ধারা। জর্ডানের একটি হকার হান্টারে পাইলটের সিটে বসে আছেন অকুতোভয় এক যুবক, এই পাল্টা প্রতিরোধের প্রধান সেনানী। সেই হকার হান্টার থেকেই সে যুবক নির্ভুল নিশানায় ঘায়েল করলেন দুই ইসরাইলি সেনাকে। ঐ মুহূর্তে কল্পনাতীত এক কাণ্ডও ঘটালেন, অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত করে ফেললেন একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো করে দিলেন তাদের আরেকটি জঙ্গী বিমান, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটি ফিরে গেল ইসরাইলি সীমানায়। চারটি হকার হান্টারের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ব্যর্থ হলো অত্যাধুনিক ইসরাইলি বিমানগুলো।
জর্ডান বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানের সেই দুঃসাহসী যোদ্ধা পাইলটটি ছিলেন একজন বাঙালি অফিসার! নাম তার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা, যিনি আকাশপথে লড়াই করেছেন তিনটি ভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর হয়ে। একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডটিও এই যোদ্ধার।
সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে, পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়াতে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশবের কিছু সময় তার কাটে কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তার পরিবার আবার ফিরে আসে বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেন এখানেই। ১৪ বছর বয়সে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয় উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষালাভের জন্য। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু’ বছর পর তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সে বছরেই তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে।
সাইফুল আজমের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় সে সময়কার মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষণ বিমান ‘সেসনা টি-৩৭’ বিমান দিয়ে। এরপর তিনি প্রশিক্ষণ নিতে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার ‘লুক এয়ারফোর্স বেইস’ এ। এই বিমানঘাঁটিতে তার প্রশিক্ষণ হয় সেই সময়ের সবচেয়ে তুখোড় জঙ্গী বিমান ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ দিয়ে। সে যুগে শব্দের চেয়ে দ্রুত গতি আর সর্বাধুনিক পাখার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ‘সোয়েপ্ট উইং’ সমৃদ্ধ ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ ছিল পঞ্চাশের দশকের সেরা দুই যুদ্ধ বিমানের একটি। অন্যটি ছিল সোভিয়েত ‘মিগ-১৫’ জঙ্গী বিমান। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আজম যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকাস্থ কেন্দ্রে।
এরপর সাইফুল আজম প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান করাচির মৌরিপুরের বিমান ঘাঁটিতে, যেটি এখন পরিচিত ‘মাশরুর বিমান ঘাঁটি’ নামে। সেখানে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ২ নম্বর স্কোয়াড্রনের ‘টি- ৩৩’ বিমানের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেন তিনি। সাইফুল আজমের সেনা জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনার একটি ঘটে এই ঘাঁটিতে। এখানেই তিনি ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। ১৯৬৩ সালে মতিউর রহমান জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন এই ঘাঁটিতে এবং সফলতার সাথে শেষ করেছিলেন ‘টি-৩৩’ জঙ্গী বিমানের প্রশিক্ষণ পর্ব।
১৯৬৫ সালে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। প্রশিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীনই সেপ্টেম্বর মাসে সাইফুল আজম যুদ্ধে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে। ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ জঙ্গী বিমান নিয়ে তুখোড় ফাইটার পাইলট আজম যুদ্ধে তার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ একটি সফল গ্রাউন্ড অ্যাটাকের পর ফিরে আসার সময় অতর্কিতে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয় সাইফুল আজমের জঙ্গী বৈমানিক দল। আকাশপথের সে যুদ্ধে আজমের নির্ভুল নিশানায় আক্রান্ত হয় একটি ভারতীয় ‘ফোল্যান্ড নেট’ জঙ্গী বিমান। সে বিমান থেকে ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয়।
আকাশপথের মুখোমুখি যুদ্ধে ‘ফোল্যান্ড নেট’ বিমানকে পর্যুদস্ত করা সে সময় এক বিরল ঘটনা ছিল। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এ ভূষিত করা হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর, কিছু আরব দেশের অনুরোধে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ক’জন পাইলটকে পাঠানো হয় জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক ও মিশরে। ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্ডানের বিমান বাহিনী ‘রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্স’-এ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সারওয়ার শাদ। তাদের দায়িত্ব ছিল জর্ডানের বিমান বাহিনীতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা।
সে সময় আরব বিশ্বে সামরিক শক্তির দিক থেকে ইসরাইল পরিচিত ছিল অজেয় এবং ভয়ঙ্করতম প্রতিপক্ষ হিসেবে। ১৯৬৭ সালে শুরু হয় তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। এর ব্যাপ্তি ছিল সাকুল্যে ৬ দিন। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রধান চার আরব রাষ্ট্র মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকের উপর আকাশপথে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় ইসরাইল। মিশর যখন তার সৈন্যদের ইসরাইল সীমান্তে নিযুক্ত করে, তখন এর জবাবে একটানা আক্রমণ করে মিশরের প্রায় গোটা বিমান বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জাম ছাতু বানিয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। জুনের ৫ তারিখেই সিরীয় বিমান বাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরাইলি বিমান সেনারা।
যুদ্ধ শুরু হবার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরাইল। পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেম তারা দখল করেছিল তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। দখল করেছিল সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। তাদের সামনে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি একটি দেশও। তাদের অবস্থা এতই করুণ হয়ে পড়েছিল যে, গামাল আবদুল নাসের তার বিপর্যস্ত বাহিনীকে সরিয়ে নিয়েছিলেন সিনাই মালভূমি থেকে। আর জর্ডান নদীর তীর থেকে নিজ সেনাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বাদশাহ হুসেইনও। প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি সৈন্য থাকার পরেও ইসরাইলের মুহুর্মুহু আক্রমণের শিকার হয়ে এই যুদ্ধে এক চরম হতাশ, বিধ্বস্ত ও দুর্বলতম শক্তিতে পরিণত হয়েছিল আরব পক্ষ।
পরিস্থিতি যখন এমন, আরবের ভিন্ন দুটি দেশের হয়ে লড়াই করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি অফিসার সাইফুল আজম। ‘এয়ারস্পেস ডগ ফাইট’, যাকে বলা যায় ‘শূন্যের বুকে সম্মুখ সমর’, তেমনই দুটি যুদ্ধে তিনি ভূপাতিত করেছিলেন তিন-তিনটি ইসরাইলি জঙ্গী বিমান।
জুনের ৫ তারিখে জর্ডানের মাফরাক ঘাঁটি থেকে প্রথমবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নেন আজম। ইসরাইলি বিমানের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য জর্ডানের পাইলটদের সাথে নিয়ে চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমানের নেতৃত্ব দিয়ে আকাশে উড়েন তিনি। ইসরাইলি বিমানগুলো এমনতর কোনো বাধার কথা কল্পনাই করে নি। আজমের নেতৃত্বে মুহুর্মুহু আক্রমণ শুরু হয় ইসরাইলি বিমানের উপর। আকাশপথে চলতে থাকে সম্মুখ যুদ্ধ। এক পর্যায়ে ইসরায়েলি পাইলট এইচ বোলেহ এর নেতৃত্বাধীন একটি ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করেন আজম। তার নির্ভুল নিশানায় ঘায়েল হয় দু’জন ইসরাইলি সেনা। এরপর আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো করে দেন আরেকটি সুপার মিস্টেরে বিমান। আঘাতপ্রাপ্ত বিমানটি ঐ অবস্থাতেই ফিরে যায় ইসরাইলি সীমানায়। মাফরাক ঘাঁটিতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেদিন যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইলের বৈমানিকেরা এসেছিল, সেটা পূরণ হয় নি। শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তারা।
এই অভাবনীয় লড়াইয়ের পরপরই জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন নিজেই বৈমানিকদের ক্যাম্পে আসেন অভিনন্দন ও অনুপ্রেরণা দিতে। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আবার আসেন সেখানে। এবারে তিনি তার গাড়িতে ওঠার আমন্ত্রণ জানান সাইফুল আজমকে। দুজনে দেখতে যান আজমের সহযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শাদকে, যিনি আগে থেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। এরপর তারা যান মাফরাক ঘাঁটিতে, ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করতে। গোটা রাস্তা জুড়েই হুসেইন ব্যস্ত ছিলেন আজমের প্রশংসা করতে। কারণ ‘অজেয়’ ইসরাইলের বিরুদ্ধে জর্ডানের ছোট্ট বিমান বাহিনী যে প্রতিরোধের শক্তি দেখিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে কেবলই আজমের কৃতিত্বে। পরবর্তীতে এই কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ জর্ডান থেকে তাকে ভূষিত করা হয় ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায়।
সাইফুল আজমের যুদ্ধকীর্তি এখানেই শেষ নয়। দু’দিন পরেই ইরাকের বিমানঘাঁটির অধিনায়কের কাছ থেকে একটি বার্তা পান তিনি। ইসরাইলি বাহিনী হামলা করতে যাচ্ছে ইরাকের বিমান বাহিনীর উপর। ইরাকী বাহিনীর প্রথম প্রতিরোধ মিশনের জন্য চারজন পাইলট প্রয়োজন জর্ডানের ঘাঁটি থেকে। আর আজমকে থাকতে হবে তাদের অধিনায়ক হিসেবে। বার্তা পেয়ে আজম এবং আরও ক’জন পাইলট জরুরি ভিত্তিতে পশ্চিম ইরাকে পৌঁছান। আরেক পাইলট ইহসান শার্দুমের সাথে আজমকে দায়িত্ব দেয়া হয় এই মিশনের। ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ ও ‘আল-ওয়ালিদ’ ঘাঁটি রক্ষা করাই হলো এই ইরাকি বৈমানিক দলের দায়িত্ব।
জুন ৭, ১৯৬৭ সাল। ইরাকী দলের সামনে ছিল ইসরাইলের চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গী বিমান। এগুলো আক্রমণ করতে এসেছিল ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ বিমানঘাঁটির উপরে। আকাশযুদ্ধে ইরাকি দল শুরু থেকেই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম। তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সে আঘাতের পর বাঁচার যখন আর উপায় নেই তখন ক্যাপ্টেন দ্রোর তার বিমান থেকে ইজেক্ট করে ধরা দেন, আটক হন যুদ্ধবন্দী হিসেবে।
এদিকে চারটি ‘ভেটোর’ বোমারু বিমানের সামনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় আজমের হকার হান্টার। ঈগলের সুতীক্ষ্ণ নজরের মতো আজমের নির্ভুল নিশানায় ধ্বংস হয় একটি ভেটোর বিমান। সেটিতে থাকা ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গোলান নিরাপদে ইজেক্ট করে ধরা দেন যুদ্ধবন্দী হিসেবে। জর্ডানের মতো এখানেও ব্যর্থ হয় ইসরাইলি বিমান দল। দুজন যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে ইসরাইলের হাতে আটক জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করা হয়।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন আকাশপথে যুদ্ধের ইতিহাসে। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সম্মুখ সমরে ভূপাতিত করেছেন সর্বোচ্চ তিনটি ইসরাইলি বিমান। ইরাকি বাহিনীর হয়ে অনন্য যুদ্ধ নৈপুণ্যের জন্য তাকে ভূষিত করা হয় ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায়।
ইরাকের এইচ-থ্রি ঘাঁটিতে সাইফুল আজমের প্রতিরোধের পর ইসরাইলি বিমান বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মওদেহাই হড বলেছিলেন, “এইচ-থ্রি ঘাঁটিতে আমাদের ব্যর্থতার জন্য যত সমালোচনার শিকার হয়েছি তাতে মনে হয়েছে, আমি যেন যুদ্ধটা হেরেই গেছি। আমাদের বিমানগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার পেছনে যত কারণই থাকুক না কেন, এটার পেছনে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটি দল ও তাদের দলপতি হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন অত্যন্ত উঁচুদরের পাইলট। এই অসম্ভব দক্ষ দলটির ব্যাপারে এমনকি মোসাদ-ও ভালো মতন জানত না।”
সাইফুল আজম ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ফাইটার পাইলট যিনি চারটি দেশের বিমান বাহিনীর সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই চারটি দেশ হলো পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও তার মাতৃভূমি বাংলাদেশ। দুটো ভিন্ন প্রতিপক্ষের বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমর জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে তার, এগুলো হলো ভারত ও ইসরাইল। তার বিরলতম অর্জন হলো, ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনটি ভিন্ন দেশ থেকে লড়াইয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ সামরিক সম্মাননা প্রাপ্তি। আরও অনন্য অর্জন আছে তার। সাধারণত ফাইটার পাইলট স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দেন বিমান বাহিনীর ‘উইং কমান্ডার’ র্যাংকের অফিসার। কিন্তু ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট’ হিসেবেই ১৯৬৬ সালে আজম পাকিস্তানে এবং ১৯৬৭ সালে জর্ডানে ফাইটার পাইলট স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দেন।
পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গী বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন আজম। এরপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ‘ফাইটার লিডারস স্কুল’ এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি।
এরপর আসে মহান ১৯৭১। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ করা সাইফুল আজম নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে হতে পারতেন এক অনন্য মুক্তিসেনা। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার। কিন্তু পাকিস্তান জানত এই অকুতোভয় যোদ্ধার দেশপ্রেমের কথা। তার জাতীয়তাবোধ এবং দেশপ্রেম অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ভয়ের কারণ ছিল। তার অব্যর্থ নিশানা যাতে নিজেদের উপর আঘাত হয়ে আসতে না পারে সেজন্য ‘৭১ সালের শুরুতেই আজমকে ‘গ্রাউন্ডেড’ করে রাখে বিমান বাহিনী। ‘গ্রাউন্ডেড’ মানে হলো, একজন পাইলটকে সাময়িকভাবে উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা।
সাইফুল আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্বল্প আলোচিত রয়ে গেছে, সেটি হলো, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে আগেই আজম নিজেও পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ও বিমান বাহিনীতে তার সহকর্মী বাঙালিদের সাথে গোপনে পরিকল্পনা করছিলেন করাচি থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একটি জেটবিমান ছিনতাই করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চের ৬ তারিখেই তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকায়। দুর্ভাগ্য, পরবর্তীতে সে পরিকল্পনা আর সফল করতে পারেননি।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের পরিকল্পনার কথাও জানতেন আজম। বিমান ছিনতাইয়ের গোপন পরিকল্পনা করার সময় তার সাথে আলাপ করেছিলেন মতিউর। ‘টি-৩৩’ জঙ্গী বিমান নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় মতিউর শহীদ হবার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আজমকে রিমান্ডে নেয় এবং টানা ২১ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। স্বাভাবিকভাবেই সেই চরম মুহূর্তে যে কোনো সময় মৃত্যুদণ্ড হতে পারত তার। কিন্তু সামরিক সম্মাননা প্রাপ্ত খ্যাতিমান বৈমানিক হওয়ার কারণে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে পাকিস্তান। একই সাথে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান না করার জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম খান ও জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনের অনুরোধ ছিল বলেও ধারণা করা হয়। গোটা যুদ্ধ চলাকালীনই আজমকে রুদ্ধ করে রাখা হয় যাতে তিনি যোগ দিতে না পারেন স্বাধীনতা সংগ্রামে।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন সাইফুল আজম। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। তাকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। বিমান বাহিনীতে ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনস এর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৯ সালে অবসর নেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে।
আশির দশকে তিনি দু’বার সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ফিল্ম ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৯১-৯৬ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন সাইফুল আজম। এরপর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আটটি ভিন্ন দেশের আট বাহিনীর বিমান পরিচালনা করেছেন আজম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জর্ডান, ইরাক, রাশিয়া, চীন ও নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের হয়ে বিমান চালিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জন আর ইতিহাস গড়া সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’ এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আকাশপথে জঙ্গী বিমান নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে সত্যিই আজম ছিলেন এক পরাক্রমশালী ঈগল পাখির মতো, যার দুরন্ত নির্ভুল নিশানা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বাহিনীকেও।
২০২০ সালের ১৪ জুন ঢাকার মহাখালী ডিএসএইচওর তার নিজ বাস ভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘদিন তিনি নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল ফখরুল আজম তার ভাই।