সুমন শেখ ও সুজন শেখ দুই ভাই। ভাঙারি দোকানে কাজ করার সময় এক দুর্ঘটনায় বড় ভাই সুমনের দুই চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হাতের দুটো আঙুল ছাড়া অন্য আঙুলগুলোও উড়ে যায়। এ ঘটনার পর সুমন ও সুজনের বাবা মারা যান। আর গত ১৮ এপ্রিল ময়মনসিংহে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সুজন।
সুজন মারা গেলে রাতেই তাঁর লাশসহ ঢাকায় আসেন সুমন ও পরিবারের সদস্যরা। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সহায়তায় সুজনের কর্নিয়া সংগ্রহ করার পর লাশ ময়মনসিংহে ফেরত নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। আর দুর্ঘটনার পরদিন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সুমনের চোখে সুজনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। সুমন এখন ছোট ভাইয়ের চোখে পৃথিবীর আলো দেখবেন।
গত ২৬ এপ্রিল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয় সুমন ও সুজনের খালা সালেহা বেগমের সঙ্গে। সেদিন তিনি বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই সুজনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সুমনের চোখে।
সুমন বললেন, ‘ভাই মারা গেছে, এ শোক তো আর কমার নয়। তারপরও ভাইয়ের চোখ দিয়ে যদি দেখতে পাই, তা–ই আমার জন্য বড় পাওয়া হবে। আমার দুর্ঘটনার পর ভাইই আমার চিকিৎসার জন্য দৌড়াইছে। সন্ধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্নিয়ার জন্য আবেদন করাইছে। চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের চিকিৎসক আবদুল কাদের স্যারের মোবাইল নম্বরও ভাইই নিয়া রাখছিল। এখন ভাইই চলে গেল।’
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক (কর্নিয়া) মো. আবদুল কাদেরের পরামর্শে খালা সালেহা বেগম সুজনের মৃত্যুর ৬–৭ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন। সঙ্গে সুজনকেও আনেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউন থাকায় তাঁদের লাশ ঢাকায় আনতে হয়। অন্য সময় সন্ধানীর দল চলে যায় লাশের কাছে।
চিকিৎসক আবদুল কাদের জানান, সুমন চার থেকে ছয় মাস পরে ভালোভাবে দেখতে পাবেন। সুমনের চোখের ছানিও অস্ত্রোপচার করতে হবে। তিনি আরও জানান, সুজনের একটি কর্নিয়া সুমনের চোখে এবং আরেকটি কর্নিয়া অন্য এক ব্যক্তির চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মরণোত্তর চক্ষুদানের ক্ষেত্রে সাধারণত দাতা ও গ্রহীতার পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। তবে সুমন ও সুজনের ঘটনাটি একটি উদাহরণের সৃষ্টি করেছে। এ থেকেই মানুষ বুঝতে পারবে যে এ ধরনের ঘটনাতেও পরিবারের সদস্যরা চাইলে চক্ষুদান করতে পারেন বা নিজের পরিবারেই কারও যদি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়, তা–ও করতে পারেন।
সুজন বিয়ে করেননি। সুমন বিয়ে করেছেন। তাঁর চার বছর বয়সী এক সন্তান আছে। বাবা ও সুজন মারা যাওয়ার পর পরিবারটিতে এখন সুমন একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। ভাঙারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দেখভাল করতে হবে সুমনকে।
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি কর্নিয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও প্রতিস্থাপনে সহায়তা করছে। সমিতির হিসাব বলছে, দেশে মোট দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৫ লাখ ২৬ হাজার মানুষ কর্নিয়াজনিত কারণে দৃষ্টিহীন। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ছাড়া এই মানুষগুলোর চোখের আলো ফিরিয়ে দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। মৃত্যুর ৮ ঘণ্টা (হিমঘরে থাকলে ১৮ ঘণ্টা) পরই মানুষের চোখ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ এই কর্নিয়া দান করলেই একজন মানুষের দুটি কর্নিয়া দিয়ে পৃথক দুজন মানুষ পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন। দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন অন্য মানুষের দয়া ছাড়াই।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সভাপতি মো. তোসাদ্দেক হোসেন সিদ্দিকী বললেন, মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কোনো ধর্মেই কোনো আপত্তি করা হয়নি। মৃত্যুর আগে নিজে দান করে না গেলেও ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরাও চক্ষুদানের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুজনের পরিবারের সদস্যরা।
মরণোত্তর চক্ষুদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানালেন, মানুষের ভুল ধারণা, চোখ তুলে ফেললে লাশের বিকৃতি ঘটবে। সাধারণত কর্নিয়া নেওয়ার পর মৃত ব্যক্তির চোখে কৃত্রিম কর্নিয়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর প্রয়োজনে পুরো চোখ তুললেও বিশেষভাবে চোখ সেলাই করে দেওয়ার ফলে বিকৃতি বোঝা যায় না।
সন্ধানীর আই ব্যাংক পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক চিকিৎসক তারিক রেজা আলী বলেন, ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই কর্নিয়া সংযোজন সফল হয়। কর্নিয়াজনিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার ৮০ ভাগই পরিহারযোগ্য বা চিকিৎসার উপযোগী। তবে কর্নিয়াদাতার সংকট প্রকট। এ পর্যন্ত যে ৪ হাজারের বেশি কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে প্রকৃত দাতার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১২০টি কর্নিয়া। ২০১৮ সালে কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয় ৩২টি (প্রকৃত দাতা ২), ২০১৯ সালে কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয় ২৩টি (প্রকৃত দাতা ৬) এবং গত বছর কর্নিয়া সংগ্রহ কমে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৯। প্রকৃত দাতা কেউ ছিলেন না। বর্তমানে করোনার প্রকোপে কর্নিয়া সংগ্রহেও ভাটা পড়েছে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক (কর্নিয়া) মো. আবদুল কাদের গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় বলেন, ইনস্টিটিউটে প্রতি মাসে তিন হাজার রোগী আসে। এর মধ্যে ৫০ জনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা জরুরি। গড়ে ২০ জন দাবিই করেন কর্নিয়া লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কর্নিয়া পাওয়া না গেলে কিছুই করার নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পর্যন্ত কৃত্রিম কর্নিয়া আবিষ্কার করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কর্নিয়া আনতে হয় বহু দাম দিয়ে।
চোখ বেঁচে থাক চোখের আলোয়
ভিটামিন এ–র অভাব, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, আঘাত, কর্নিয়ার আলসারসহ বিভিন্ন কারণে এ ধরনের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা হতে পারে। সন্ধানীর হিসাব বলছে, বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। প্রতিবছর নতুন করে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে আরও প্রায় ৪০ হাজার মানুষ।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির মহাসচিব জয়নুল ইসলাম বললেন, করোনার আগে সন্ধানী প্রতিবছর গড়ে ৬০–৬৫টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করত। প্রতিবছর গড়ে ৬০টি হিসাবে ধরলেও দেশ থেকে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করতে লাগবে প্রায় ৮ হাজার বছর। আগামী ১০ বছরে দেশ থেকে এ ধরনের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা দূর করতে চাইলে প্রতিবছর ৩৬ হাজার কর্নিয়া সংগ্রহ করা প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে বছরে মোট মৃত (প্রায় ১০ লাখ) ব্যক্তির দুই শতাংশের কাছ থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারলে কিছুটা আশার আলো দেখতে পাওয়া যায়।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকের সমন্বয়ক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, ‘কর্নিয়ার জন্য কয়েক হাজার আবেদন জমে আছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানের চক্ষু ব্যাংক, চক্ষু হাসপাতালসহ সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছি। তবে চক্ষুদানে মানুষ এগিয়ে না এলে আমাদের বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’